Advertisement
E-Paper

ভুল রাজনীতির মাসুল

বিরোধী দলের বাধা নিয়ে শাসকরা চিন্তিত নন, বরং ‘ওরা দেশের মঙ্গল চায় না’ বলে সেই প্রতিবাদকে যথারীতি নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে তৎপর হয়েছেন।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩ ০৫:১৭
Share
Save

আজও, স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরেও, দেশের সব নাগরিকের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তিত হয়নি, এটা ভারতীয় রাজনীতির এক বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার পিছনে লিবারাল বা উদারপন্থীদের ভুল রাজনীতির একটি বড় ভূমিকা আছে। তবে আপাতত এই বিষয়ে নির্বাচনী খেলা খেলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের সামনে অন্তত প্রাথমিক ভাবে এক উভয়সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, সে-কথা তাঁরাও অস্বীকার করতে পারবেন না। লোকসভা নির্বাচনের পূর্বাহ্ণে শাসকরা এই উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। প্রধানমন্ত্রী কার্যত সেই অভিযানে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েছেন, নির্বাচন-অভিমুখী মধ্যপ্রদেশে অভিন্ন বিধির সপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে বিচিত্র যুক্তি এবং সস্তা আবেগের মিশেল দিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেশের তুলনা করে বলেছেন, পরিবারের এক-এক জন এক-এক নিয়ম মানলে পরিবার কী করে চলবে? এই সবুজসঙ্কেত ব্যর্থ হয়নি। বাবু যত বলেন, পারিষদ দলে তার শতগুণ বলে চলছিলেন। আম আদমি পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন ধ্বনিত হতেও দেরি হয়নি।

কিন্তু অচিরেই প্রধানমন্ত্রী টের পেলেন, তাঁর চলার পথে বাধা আছে, বিপত্তিও। বিরোধী দলের বাধা নিয়ে শাসকরা চিন্তিত নন, বরং ‘ওরা দেশের মঙ্গল চায় না’ বলে সেই প্রতিবাদকে যথারীতি নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে তৎপর হয়েছেন। কিন্তু বেসুর বাজছে বিরোধী দলের বৃত্তের বাইরে বৃহত্তর পরিসরেও, শরিক বা সহগামীদের বলয়েও। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন জনজাতি অভিন্ন বিধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্তরোত্তর প্রবল হয়ে উঠেছে। নাগাল্যান্ড, মিজ়োরাম, মেঘালয়ের মতো রাজ্যে শাসক জোটের শরিক দলগুলি সরাসরি সেই প্রতিবাদে মুখর, এমনকি জোট ভেঙে যাওয়ার সতর্কবাণীও শোনা গিয়েছে। বিবিধ ঐতিহ্যের মধ্যে অভিন্ন বিধিকে তাঁরা অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক হিসাবে দেখছেন। অবস্থা সামাল দিতে বিজেপির প্রবীণ নেতা এবং সাংসদ সুশীল মোদী বলেছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আওতা থেকে জনজাতিগুলিকে বাদ দেওয়া যায়, ‘সব নিয়মেরই তো ব্যতিক্রম থাকে’! এমন বড় আকারের ব্যতিক্রম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুখী পরিবার ‘কী করে চলবে’, সেই প্রশ্ন অবশ্য সুশীল মোদীকে করার অর্থ নেই, আর যাঁকে করার অর্থ আছে, তিনি প্রশ্ন নেন না।

পুরো ঘটনাটির বিপদ দু’টি। দু’টি বিপদই প্রবল, গুরুতর। একটি বিপদ অভিন্ন বিধি প্রবর্তনের প্রসঙ্গটির এ-হেন রাজনৈতিক ব্যবহারের। বহুত্বময় ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর, বিশেষত জনজাতির নিজস্ব নিয়ম, রীতি এবং প্রথাকে সম্মান করেও কী ভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তন করা যায়, সেটা এক রকমের বিপদ। মুসলিম সমাজের উপর অভিন্ন বিধির শাসন চাপিয়ে দেওয়ার খেলাও তার মধ্যে পড়ে। দ্বিতীয় বিপদটি গভীরতর। অভিন্ন বিধি প্রবর্তন একটি জরুরি কাজ, গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকত্বের সমতা প্রতিষ্ঠার একটি অতি জরুরি ধাপ। সংবিধান রচনার সময় থেকেই সে কথা স্বীকৃত। কিন্তু এই সব রাজনীতির মধ্যে সেই যৌক্তিকতা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। এ যেন এখন কেবল হিন্দুত্ববাদের ‘অ্যাজেন্ডা’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই ঘটনার মধ্যে যেমন হিন্দুত্ববাদী নেতাদের আগ্রাসন-আকাঙ্ক্ষা আছে, তেমনই আছে উদারপন্থীদের ব্যর্থতা। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরেও তাঁরা এ নিয়ে কোনও উদার, মুক্ত আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি। যাঁরা আপত্তি তোলেন তাঁদের সঙ্গে মতের আদানপ্রদানের চেষ্টা করেননি। অথচ, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য সমাজের সঙ্গে যথার্থ গণতান্ত্রিক সংযোগের মধ্য দিয়ে ক্রমে কিন্তু আবশ্যিক ভাবে সেই পরিবর্তনের পথে যাওয়া দরকার, এটাই ছিল স্বাধীন ভারতের সিদ্ধান্ত। গত এক দশকে যে এত গুরুতর কাজটি কেবল হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগুরুতন্ত্রের কুক্ষিগত হয়ে গেল, তাতে ভারতের গণতান্ত্রিক, উদারতান্ত্রিক সমাজের দায়িত্বও বিরাট।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Uniform Civil Code Government of India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}