Advertisement
E-Paper

এত মৃত্যু কেন

এই বিপন্নতার কারণ কী? প্রতিবেশী চেনা হোক কি অচেনা, আত্মহত্যা-খুনের মতো ঘটনায় তাঁদের জীবন ঝরে গেলে সমাজে আপাত শান্তি-স্থিতির ভারসাম্যটি নড়ে যায়।

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৫ ০৫:৪৪
Share
Save

এমন এক-একটা সময় আসে যখন চার দিকে তাকালে কেবলই মৃত্যু চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত কলকাতায় এই সময়টি ঠিক সেই রকম— গত এক সপ্তাহের মধ্যে প্রচারমাধ্যম জুড়ে শিউরে-ওঠার মতো কিছু মৃত্যুর ঘটনা, যার কেন্দ্রে আছে আত্মহত্যা ও হত্যা। ট্যাংরা, বেহালা, মধ্যমগ্রাম— শহরের ভূগোলে এক-এক প্রান্তে থাকা এই স্থানগুলি উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে। কোথাও বাড়ির দুই সদস্যকে খুন করে, এক শিশুপুত্রকে গাড়িতে তুলে আত্মহত্যা করতে বেরিয়ে পড়েছেন দুই ভাই, কোথাও অটিস্টিক স্পেকট্রাম-এ থাকা তরুণী মেয়েকে দড়ির ফাঁসে ঝুলিয়ে সেই একই দড়িতে ঝুলে পড়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব অবসাদগ্রস্ত পিতা, কোথাও পাঁচ বছরের শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে নিজে বিষ খেয়েছেন তরুণী মা। খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ঘটেছে বলেই হয়তো এই ঘটনাগুলির অভিঘাত দিশাহারা করে দেওয়ার মতো— হাতে গোনা যাঁরা বেঁচে গেলেন শুধু তাঁদেরই নয়, বৃহত্তর সমাজেরও এক রকম বিপন্নতার বোধ অনুভূত হচ্ছে।

এই বিপন্নতার কারণ কী? প্রতিবেশী চেনা হোক কি অচেনা, আত্মহত্যা-খুনের মতো ঘটনায় তাঁদের জীবন ঝরে গেলে সমাজে আপাত শান্তি-স্থিতির ভারসাম্যটি নড়ে যায়। তার জায়গায় স্থান করে নেয় এই অস্বস্তি ও অপরাধবোধও যে, এত কাছে থেকেও সেই মানুষগুলির খোঁজ নেওয়া হয়নি কখনও, জানা হয়নি তাঁরা সত্যিই কেমন আছেন, রোজকার দৃশ্যমান গতানুগতিকতার আড়ালে তাঁরা কতটা অসুখী ও উদ্বিগ্ন— কী কারণে। ট্যাংরার পরিবারটি বিপুল আর্থিক ঋণে ডুবে ছিল, বেহালার মধ্যবয়সি পিতা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় ছিলেন অটিস্টিক মেয়ের চিকিৎসা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে, মধ্যমগ্রামের তরুণী মায়ের ক্ষেত্রে পারিবারিক অশান্তিই কারণ কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, দেনা বা পারিবারিক অশান্তির দায় তো সেই মানুষগুলিরই, রোগ-অসুখেও সমাজের হাত নেই। কিন্তু সমাজের অবশ্যই দায় আছে এমন এক মানসিক পরিবেশ তৈরির যেখানে এই মানুষগুলি অন্তত কারও সঙ্গে নিজের দুঃখ অশান্তি উদ্বেগ ভাগ করে নিতে পারবেন; যত বড় সমস্যাই হোক, কোনও না কোনও পথ তাঁকে কেউ দেখাবে। উপরের প্রতিটি ঘটনায় এর ব্যতিক্রমই বুঝিয়ে দিয়েছে, এই শহর ও সমাজ একটি সুস্থ সহমর্মী মানসিক পরিবেশ তৈরিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ।

এতগুলি প্রাণ চলে গেল, এতে কি প্রশাসনেরও দায় নেই? সমাজ-মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, রাষ্ট্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সমাজও: শাসকের রূঢ়তা, ভ্রুকুঞ্চন ফুটে ওঠে সমাজের নির্মম আচরণে। গণতন্ত্রে সবই নাগরিকের কল্যাণে হলেও ভারতে প্রতি পদে তার অপলাপ চোখে পড়ে— নাগরিকের জীবনযাত্রা এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশাসনের নীতিহীনতা বা দুর্নীতি দ্বারা পীড়িত। সাধারণ নাগরিকের চাওয়া বেশি কিছু নয়— মাস গেলে মাইনে, খাওয়া-পরা, প্রয়োজনে চিকিৎসা। এই সাধারণ চাহিদাটুকুর জবাবে এ রাজ্যের নাগরিকেরা দেখে আসছেন শুধুই প্রশাসনের বাহ্য বাগাড়ম্বর, আর ভিতরে দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা। যদি পুলিশি তদন্তে জানা যায় যে, বিপুল ঋণভারের পিছনে কোনও রাজনীতি বা ব্যবসার কারবারির যোগ ছিল, অটিস্টিক সন্তানের চিকিৎসার জন্য সরকারের দ্বারে ঘুরেও এক পিতা কিছুই পাননি, তার দায় কি প্রশাসনের নয়? কোন ‘জনপ্রতিনিধি’ সেই উত্তর দেবেন?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Suicide Murder Society Administration

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy