এক কালে বাংলায় অতি কঠোর তিরস্কারের বুলি ছিল, ‘অধঃপাতে যাও’। বাঙালির সেই যাত্রা সম্পন্ন হয়েছে। কত দূর, তা বুঝতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-বর্ণিত মুচিরাম গুড়ের শরণাপন্ন হওয়া যায়। মূর্খ, অলস ও কুবুদ্ধিধারী মুচিরামও যাত্রাদলের অধিকারীমশাইকে ‘উভয় হস্তের অঙ্গুলি উত্থিত করিয়া তাহাকে কদলীভোজনের অনুমতি’ করেছিল, এবং তার পূর্বে ‘নানাবিধ অবক্তব্য কদর্য্য ভাষায় মনে মনে সম্বোধন’ করেছিল। আজকের বঙ্গজনের তুলনায় মুচিরাম নেহাত দুধের শিশু। বঙ্গাব্দ চতুর্দশ শতকের বাঙালি নিতান্ত বিনা কারণে গালি দেয়, সামান্য কারণে পিটিয়ে ছাতু করে দেয়, অপভাষা, অপশব্দের ফোয়ারা ছোটায়। বাঙালির ইতরায়ণ আজ পূর্ণ। না, অতীতের বাঙালিমাত্রেই গোপালকৃষ্ণ গোখলের বক্তব্যের মূর্ত প্রতিনিধি ছিল না। সেই বাঙালিরও ক্ষুদ্রতা ছিল, হীনতা ছিল। ‘নিমন্ত্রণ-সভা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দশটা বাঙালিকে একত্রে জড়ো করিবার প্রধান উপায় আহারের লোভ দেখানো, বাঙালিদের অপেক্ষা আরও অনেক ইতর প্রাণীকেও ওই উপায়ে একত্রিত করা যায়।” অতীতের বাঙালি ‘শ্রেণিশত্রু’ খতম করার বালখিল্য উৎসাহে সামান্য মাইনের পুলিশ কনস্টেবলদের মেরেছে; দাঙ্গা করে দীর্ঘ দিনের প্রতিবেশীর ঘরে আগুন দিয়েছে। লোক ঠকিয়েছে, ক্ষমতার সামনে নতজানু হয়েছে— বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, “বাঙালি তেলা মাথায় তেল ঢালিয়া দেয়।” কিন্তু তার পরও পতনের কতখানি বাকি ছিল, আজকের বাঙালি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ‘বাঙালিত্ব’ বলতে যে বিমূর্ত ধারণাটিকে বোঝায়, আজকের বাঙালি সর্বশক্তিতে সেই ধারণাটির বিপ্রতীপ মূর্তি হয়ে উঠতে চায়।
বাঙালিত্বের নির্যাস কী, এই প্রশ্ন করলে একটি শব্দ বহুব্যবহারসিদ্ধ: ভদ্রলোক। বিগত কয়েক দশকের বিদ্যাচর্চায় ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতির কপালে বিস্তর তিরস্কার জুটেছে। কেন, সেই তাত্ত্বিক আলোচনার পরিসর এই নিবন্ধ নয়, তবে তিরস্কারগুলি সুপ্রযোজ্য। কিন্তু, শব্দটির আদিতে এক নতুন নাগরিক সংস্কৃতিতে উত্তরণের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটি ছিল, তার গুরুত্ব অস্বীকার করলে অন্যায় হবে। বিদ্যাচর্চা, সংস্কৃতিমনস্কতা, বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠা, সর্বার্থে সুসভ্য হওয়ার প্রয়াস— এই ছিল ভদ্রলোকের আদিকল্প, নবজাগরণের উত্তরাধিকার। শ্রেণিটি বিলক্ষণ সীমিত ছিল— তার পরিধি বিস্তারের জন্য যে প্রয়াস জরুরি ছিল, শ্রেণির অধিকারীরা সজ্ঞানেই তার বিপরীত পথে হেঁটেছিলেন, হাঁটছেন। তবু ‘ভদ্রলোক’ হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষাটি ছিল বাঙালি সমাজের এক বড় অংশের চালিকাশক্তি। দেশভাগ-পরবর্তী উদ্বাস্তু কলোনির দরমার ঘরেও সন্ধেবেলা শোনা যেত রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেওয়াজ; মফস্সলের ক্লাবঘরে চলত নাটকের মহড়া।
বাঙালির ইতরতাও বাঁধা ছিল ভদ্রলোকের অলঙ্ঘ্য গণ্ডিতে। রবীন্দ্রনাথ ‘ততঃ কিম’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “আজ আমরা... ইতর হইয়া উঠিয়াছি, কলহে মাতিয়াছি, পদ ও পদবী লইয়া কাড়াকাড়ি করিতেছি, বড়ো অক্ষরের ও উচ্চকণ্ঠের বিজ্ঞাপনের দ্বারা নিজেকে আর পাঁচজনের চেয়ে অগ্রসর বলিয়া ঘোষণা করিবার প্রাণপণ চেষ্টা চলিতেছে।” নিজেকে পাঁচ জনের চেয়ে অগ্রসর হিসাবে প্রতিপন্ন করার বাসনাটি— অর্থাৎ, ‘ভদ্রলোক’ হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আজকের বাঙালি সম্পূর্ণ বর্জন করেছে। পিছিয়ে পড়তে তার আর লজ্জা নেই, বরং গৌরববোধ আছে, বাঙালি এখন গোবলয়ের বাহুবলীদের আদর্শ ঠাওরায়। সমাজের ভদ্রলোকের ক্ষুদ্র অথচ প্রভূত ক্ষমতাবান গণ্ডিটি ভাঙার প্রয়োজন ছিল— অনস্বীকার্য। ‘অপরূপভাবে ভাঙা, গড়ার চেয়েও মূল্যবান কখনো সখনো’। কিন্তু, যতটুকু অর্জন ছিল, সেই ভাঙন ভাসিয়ে নিয়ে গেল তা-ও। এই ইতরতা, এই হীনতাকে সঙ্গী করেই আরও একটি নতুন বছর শুরু করবে বাঙালি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy