রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনীর কনস্টেবল রিনা সম্ভবত স্বপ্নেও ভাবেননি যে, এক দিন তাঁর ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হবে, গোটা দেশ তাঁকে নিয়ে চর্চায় মাতবে। ভাবার কথাও নয়। তিনি ভারতের বিপুল রাষ্ট্রযন্ত্রের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশমাত্র। তাঁর একটি এক বছর বয়সি সন্তান আছে, কাজে আসার সময় যাকে রেখে আসার মতো জায়গা নেই। ফলে, যে দিল্লি স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল ১৮ জনের, সেখানেই— সেই দুর্ঘটনার ঠিক পরের দিন— সন্তানকে বুকের সঙ্গে বেঁধে লাঠি হাতে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। কোনও ফটো-অপ নয়, কোনও বিবৃতি প্রদানের চেষ্টাও নয়, নিতান্তই তাঁর প্রাত্যহিকতার অঙ্গ এই ঘটনাটি। হয়তো অন্য কোনও সময় হলে তা নিছক সাময়িক কৌতূহলের কারণ হত স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের; বড় জোর কেউ হয়তো একটা ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতেন। কিন্তু, কুম্ভমেলায় যাওয়ার ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে সন্তান-কোলে রিনার ছবিটি মুহূর্তে ভাইরাল হয়েছে। এক ওয়াল থেকে অন্য ওয়ালে ছড়িয়ে পড়েছে সেই দৃশ্য। বেশির ভাগ মানুষই ছবিটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত। কেউ বলছেন, এই তো আদর্শ নারীর ছবি, যিনি দশভুজার মতো একই সঙ্গে সংসারের দায়িত্বও পালন করেন, আবার বাইরের দায়িত্বও। কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই হল মাতৃমূর্তি— কোনও দায়িত্বই যাঁকে সন্তানের প্রতি কর্তব্যপালন থেকে আটকাতে পারে না।
রিনার ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। সন্তানকে বুকের সঙ্গে বেঁধে যে মা বাগানে চা পাতা তুলতে যান; ইটভাটায় কর্মরত যে মা বাধ্য হন সন্তানের কোমরে দড়ি বেঁধে তাকে সারা দিন গনগনে গরমের পাশেই বসিয়ে রাখতে; অথবা লোকের বাড়িতে ঠিকা গৃহসহায়িকার কাজ করা যে মাকে দেখতে হয়, তাঁর সন্তান সারা দিন বিবিধ অবহেলা সহ্য করেও খেলে চলেছে ধুলোয় বসে— সে মায়েরা ভাইরাল হননি। কিন্তু, রিনাকে বা এই অজস্র মায়ের মধ্যে কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, কেন তাঁরা সন্তানকে কাজের জায়গায় নিয়ে যান, সেই প্রশ্নের উত্তরে নারীশক্তির জয়ধ্বনি অথবা মাতৃত্বের মহিমাবর্ণন শুনতে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ। তাঁরা এক বাক্যে জানাবেন, কাজে আসার সময় সন্তানকে কোথাও রেখে আসার উপায় নেই বলেই তাঁরা বাধ্য হন ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে তাদের নিয়ে আসতে। এই মায়েদের অনেকেই পরিযায়ী— ফলে, পরিবারের বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত থেকে তাঁরা অনেক দূরে। আর, রাষ্ট্র তাঁদের দিকে তাকায়নি। ফলে, তাঁরা সন্তানের হাত ধরে প্রতি দিন বিপদের দিকে হেঁটে যান— ভাগ্য ভাল থাকলে সন্ধ্যায় ফিরেও আসেন গৃহকোণে। এঁদের পাশাপাশি আছেন আরও বিপুলতর সংখ্যক মা, যাঁরা এতখানি সাহসী হতে পারেননি, বা এতখানি বিপন্ন হননি। সন্তানের মুখ চেয়ে তাঁরা বাইরের পেশার জগৎকে বিদায় জানিয়ে আর্থিক স্বাধীনতাহীন গৃহবধূতে পরিণত হয়েছেন। বছরে এক বার, ‘মাদার্স ডে’-তে সমাজ তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; বাকি ৩৬৪ দিন তাঁরা অকিঞ্চিৎকর, পরিবারের পরিসরেও হামেশাই ঊনমানবী।
সন্তান-কোলে স্টেশনে কর্মরত নিরুপায় মায়ের ছবি-ভিডিয়ো ভাইরাল করে তাকে মাতৃত্বের উদ্যাপনের মুহূর্ত করে তোলা সমাজের পক্ষেও সুবিধাজনক, রাষ্ট্রের পক্ষেও— অকুণ্ঠ বাহবা জানিয়ে দিলে আর পরিস্থিতির অসহ অন্যায্যতার দায়গ্রহণের প্রশ্ন থাকে না। কৌশলটি সোশ্যাল মিডিয়ার আবিষ্কার নয়— পুরুষতন্ত্রের ‘সম্মতির ভিত্তিতে অবদমন’-এর রাজনীতি এই কৌশলেই চলে। যাঁরা রিনার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, অথবা যাঁরা ‘মা হওয়া কি মুখের কথা’ আওড়ে মেয়েদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আটকে রাখতে চান লিঙ্গ-নির্ধারিত ভূমিকার খাঁচার অনতিক্রম্য বাধায়, তাঁরা প্রত্যেকেই আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে, রাষ্ট্রকে একটি অনিবার্য প্রশ্নের হাত থেকে রক্ষা করছেন— মেয়েদের পূর্ণ নাগরিক হিসাবে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার জন্য যে মৌলিক জিনিসগুলি প্রয়োজন, রাষ্ট্র আর কবে তার ব্যবস্থা করবে? কর্মরত মায়েদের সন্তানকে রাখার জন্য প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ক্রেশ তৈরি হবে কবে? অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্যও কবে সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক হবে? আর কত দিন শুধুমাত্র মেয়ে বলেই কর্মক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকতে বাধ্য হবেন মেয়েরা— মেনে নেবেন যে, মায়ের দায়িত্ব পালনের পর এর বেশি আর তাঁদের প্রাপ্য হয় না? রিনাকে মাতৃমূর্তিতে পরিণত না করে রাষ্ট্রকে এই প্রশ্নগুলি করলে শেষ অবধি মেয়েদের অনেক বেশি উপকার হত।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)