Advertisement
E-Paper

এই অসংযম কেন

সংযম ও সভ্যতার এই সামগ্রিক চিত্রমালার প্রেক্ষাপটেই বিশেষ ভাবে শ্রুতিকটু এবং দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে একাধিক কুকথা এবং কুদৃশ্য।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৫:৩৩
Share
Save

আর জি কর হাসপাতালের পৈশাচিক ঘটনাটির পরে ঠিক এক মাস অতিক্রান্ত। স্বাধীনতা দিবসের পূর্ববর্তী মধ্যরাত্রিতে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ নামাঙ্কিত অভিযানের সূত্র ধরে নাগরিক প্রতিবাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনেরও তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেল। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের ঘোলা জলে মাছ ধরার উৎকট প্রয়াস এবং শাসক দলের ‘আমরাও বিচার চাই’ বলে গলা মেলানোর লজ্জাকর ব্যগ্রতা সেই সামাজিক আন্দোলনকে তার লক্ষ্য এবং পথ থেকে, অন্তত এখনও পর্যন্ত, ভ্রষ্ট করতে পারেনি। বরং একের প্রতিস্পর্ধা অপরকে প্রেরণা দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে; সমাজের নতুন নতুন পরিসর থেকে নাগরিক ও ভাবী নাগরিকরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব, সমবেত এবং সক্রিয় হয়েছেন। সেই সমবেত কণ্ঠস্বর, অবস্থান ও মিছিল বহুলাংশেই সংযত ও শালীন, আবেগ এবং উচ্ছ্বাস অহিংসার পথে সুস্থিত— সেই অহিংসা ভয়গ্রস্ত দুর্বলের নয়, যথার্থ সাহসীর অহিংসতা, যার ঐতিহাসিক নিদর্শন মিলেছিল কলকাতা পুলিশের সদর দফতরের সামনে প্রতিবাদী জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে।

সংযম ও সভ্যতার এই সামগ্রিক চিত্রমালার প্রেক্ষাপটেই বিশেষ ভাবে শ্রুতিকটু এবং দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে একাধিক কুকথা এবং কুদৃশ্য। কার প্রতিবাদের অধিকার আছে, কার নেই, কে কার সঙ্গে প্রতিবাদে সমবেত হবেন বা হবেন না, ইত্যাকার নানাবিধ সওয়াল-জবাব সমাজমাধ্যমে অনিবার্য, কিন্তু অনেক সময়েই তার শব্দ এবং সুর দুই-ই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার পাশাপাশি প্রতিস্পর্ধী জমায়েতে যোগ দেওয়ার প্রশ্নে প্রতিবাদীদের পারস্পরিক বিরাগ অনেক সময়েই বিদ্বেষের রূপ নিয়েছে, সম্প্রতি শ্যামবাজারে একটি নৈশ অবস্থানে পশ্চিমবঙ্গের এক বরিষ্ঠ অভিনেত্রীর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে যা নিছক প্রত্যাখ্যানেই সীমিত থাকেনি, তাঁর নিগ্রহের উপক্রম অবধি ঘটেছে। একটি অপরাধের বিরুদ্ধে, একটি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এসে যাঁরা নিজেদের বিরাগ প্রকাশের তাড়নায় এমন মারমুখী হয়ে ওঠেন, তাঁরা কেবল গোটা প্রতিবাদের মর্যাদাহানি ঘটাচ্ছেন না, এই আন্দোলনের নৈতিকতাকেও খর্ব করছেন। যাঁর বা যাঁদের সম্পর্কে যত আপত্তিই থাকুক না কেন, এমন অসংযমের কোনও অধিকার কারও থাকতে পারে না, বিশেষত জনপরিসরে।

একটি প্রচলিত ‘যুক্তি’ এ ক্ষেত্রেও শোনা যাচ্ছে: ‘জনতা’র আচরণ এমনই হয়ে থাকে। হয়ে থাকে, অবশ্যই। এক অর্থে এই অসংযমী আচরণ সমাজের বাস্তব চরিত্রটিকেই দেখিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তব বলেই তা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এই সমাজের বহু জনসমাবেশই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংযত ও সুসভ্য আচরণের পরাকাষ্ঠা রেখে চলছে, যা এই সামাজিক প্রতিবাদকে তার সত্যকারের শক্তি দিতে পেরেছে। সুতরাং কোথাও জনতার একটি অংশ অশালীন বা হিংস্র হয়ে উঠলে তার আচরণকে কঠোর ভাবে সমালোচনা করাই কর্তব্য। কিন্তু সেই সমালোচনা যথেষ্ট জোরদার নয়। সেটাই গভীরতর উদ্বেগের কারণ। হিংস্র অসংযম বিশেষ স্থান-কালের বিশেষ উত্তেজনার পরিণামে সীমিত থাকছে না, অনেক মানুষ নানা পরিসরে, বিশেষত সমাজমাধ্যমে, এই আচরণের সমর্থনে ঠান্ডা মাথায় নানা কুযুক্তি সরবরাহ করছেন। যেমন, অভিনেত্রীর প্রতি অশালীন আক্রমণের সপক্ষে জোরদার সওয়াল শোনা যাচ্ছে, যা ওই রাত্রির ঘটনার থেকে কম অশালীন নয়। যাঁরা এমন সওয়াল খাড়া করছেন তাঁরা সব থেকে বড় ক্ষতি করছেন প্রতিবাদী ও প্রতিস্পর্ধী আন্দোলনেরই। একটি ভয়াবহ ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের সামনে যথার্থ প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলার এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু পায়ের নীচে নৈতিক অবস্থানটি যদি ঠিক না থাকে, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ যদি প্রতিবাদীদের বেসামাল করে দেয়, তবে সেই সুযোগ ঘোলা জলেই হারিয়ে যাবে। যথার্থ প্রতিবাদ দায়িত্বজ্ঞানহীন বেপরোয়ার কাজ নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Shyambazar Kolkata Doctor Rape and Murder

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}