—ছবি : সংগৃহীত
রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা: সবই তো সমান জরুরি নয়। বেশ খানিক সময় কেটে গেলে বোঝা যায় কোনটা জরুরি, কোনটা নয়, আবার তার মধ্যেও কোনটা তাৎক্ষণিক জরুরি, কোনটা সুদূরপ্রসারী। সময়ের সেই পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়া সহজ কথা নয়। তাই, সাম্প্রতিক পৃথিবীতে গণতন্ত্র নামে যে বস্তুটি পরিচিত, তার দিকে ফিরে মনে হয় যে স্বল্পাধিক অর্ধশতক আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নামে যে ঝড়টি বয়ে গিয়েছিল, গুরুত্বের দিক দিয়ে তা এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। এমনই ঐতিহাসিক যে, এখনও পর্যন্ত— কেবল আমেরিকায় নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও— কোনও বড় মাপের কেলেঙ্কারিকে ‘গেট’ দিয়ে অভিহিত করার চল আছে। ওয়াটারগেট কেবল একটি ঘটনামাত্র নয়— একটি অভিজ্ঞতার নাম, বলা চলে। হোয়াইট হাউস-এর লৌহযবনিকার অন্তরালে পৌঁছে যে এমন মাপের কোনও গোপনীয়তার বলয় ভেদ করে ফেলা সম্ভব, এবং প্রেসিডেন্টের মতো অমিতবিক্রম পদাধিকারীকে অভিযুক্ত করে জনসমক্ষে তা প্রকাশ ও প্রমাণ করা সম্ভব, সেটা ওই ওয়াটারগেট-এরই অভাবিত-পূর্ব কৃতিত্ব।
কী ছিল ওয়াটারগেট অভিজ্ঞতা? ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বিরুদ্ধে অতীব গুরুতর সব অভিযোগ উঠে এসেছিল— যার ফলে ১৯৭৪ সালে, আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করেন। অভিযোগগুলির মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিল, কী ভাবে প্রেসিডেন্ট তাঁর অত্যুচ্চ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছেন, কী ভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ ক্ষমতা সুরক্ষিত করেছেন, কী ভাবে তথ্যপ্রমাণ চাপা দিয়ে জনসমক্ষে স্বচ্ছতার ভান করেছেন, কী ভাবে গণতান্ত্রিক বাক্-স্বাধীনতার আবডালে সযত্নপোষিত কর্তৃত্ববাদ চালু রেখেছেন। নিক্সনের বিরুদ্ধে ‘ইম্পিচমেন্ট’ হয়, শেষ পর্যন্ত ‘পার্ডন’-ও পান। তবে কিনা, এ কেবল কোনও বিশেষ প্রেসিডেন্ট-এর ব্যক্তিগত সঙ্কটের কাহিনি ভাবলে ভুল হবে। নিক্সনের ব্যক্তি-ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, তাঁর সূত্রে উঠে আসা অভিযোগগুলি আসলে ধারে এবং ভারে আরও অনেক বড়। ক্ষমতাতন্ত্রের শীর্ষে অধিষ্ঠিত নেতার ক্ষমতার অপব্যবহারের সম্ভাবনার দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই অভিযোগসমূহ। বাস্তবিক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি ক্ষমতাতন্ত্রের যে অহঙ্কার ও প্রত্যয়— সেটাকেই খুব বড় মাপের নাড়া দিয়ে গিয়েছিল ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। দুই অসমসাহসী সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইন যে ভাবে অনেক বাধা-প্রতিঘাত পেরিয়ে ‘হুইসল-ব্লোয়ার’-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাতে সে দেশের সংবাদমাধ্যমের গৌরব ঝলকে ঝলকে বেড়েছিল। বোঝা গিয়েছিল গণতান্ত্রিকতার আড়ালে সুরক্ষিত দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতাতন্ত্রের সঙ্গে যদি পাল্লা দিতে হয়, তা হলে সংবাদ-যোদ্ধারাই একমাত্র ভরসা, একমাত্র শক্তি। এই প্রত্যয় আমেরিকার মাটিতে অনেক কাল অটুট ছিল। বলা হত, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা এই ঘটনার পর পাহারাদার-সারমেয় (ওয়াচডগ) থেকে এক ধাক্কায় শিকারি সারমেয় (জাঙ্কইয়ার্ড ডগ)-তে পরিণত হল। সাম্প্রতিক কালে গণতন্ত্রবিরোধী দক্ষিণপন্থী অসহিষ্ণু দাপটের মধ্যেও এখনও যে তার ‘শিকারি’ ভূমিকা কিয়দংশে উজ্জ্বল, তার প্রমাণ পূর্বতন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইম্পিচমেন্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়াতেই যথেষ্ট প্রকাশিত।
তবে ট্রাম্পের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায় নিক্সন-যুগের সঙ্গে প্রভেদটা ঠিক কোথায়। তখন আমেরিকার বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতা, সবলতা ও আত্মপ্রত্যয় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। কোনও রাজনৈতিক প্রভাবে তাকে হেলানো যেত না। সেই স্বাধীনতাই ওয়াটারগেট সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সাফল্যের প্রধান কারণ ছিল। তুলনায়, এখন সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক প্রভাবে এমন গভীর ভাবে সিঞ্চিত যে, সেখানে রাজনৈতিক দুর্নীতির উন্মোচনের ঘটনায় সহায়তার আশা মরীচিকা। ফলে ট্রাম্পও আজ বড় গলায় দাবি করতে পারেন, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ যতই তুফান তুলুক, তাঁর গায়ে শাস্তির আঁচড়টুকুও পড়বে না। বাস্তবিক, গণতন্ত্রের যে মূল প্রতিষ্ঠানগুলি, সেগুলিকে এক বার নষ্ট করে দিলে গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে বাধ্য। ওয়াটারগেট গণতন্ত্রের স্পর্ধার শক্তিটিই কেবল দেখিয়ে দেয়নি, তার সেই শক্তির সীমাটি কোথায়, সেই বার্তাও দিয়ে গিয়েছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy