নর্দমার বিষবাষ্পে নিহত তিন শ্রমিকের মৃত্যুর দায় তাঁদের উপরেই চাপালেন ফিরহাদ হাকিম। মেয়রের দাবি, শ্রমিকরা নাকি সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিয়েই ম্যানহোলে নেমে পড়েন। তাঁর এই অভিযোগ বিষবাষ্পের মতোই শ্বাসরুদ্ধ করে দিতে চায় রাজ্যবাসীর। ওই শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য সুরক্ষার সরঞ্জাম সত্যিই কি ছিল? অক্সিজেন মাস্ক, সুরক্ষা পরিচ্ছদ, নিদেনপক্ষে ত্রিশ ফুট গভীর নালায় নামার আগে কোমরে বাঁধার উপযোগী লম্বা একটা দড়ি? ম্যানহোলে বিষাক্ত বাষ্প জমে রয়েছে কি না, তা কি আগে পরীক্ষা করা হয়েছিল, বিশেষত যখন তা ছিল বানতলা চর্মনগরীর রাসায়নিক-দূষিত জল নিকাশির পথ? নালায় নেমে জল আটকানোর মতো বিপজ্জনক কাজে কি ওই শ্রমিকদের কোনও প্রশিক্ষণ, পারদর্শিতা বা পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল? সর্বোপরি, ত্রিশ ফুট গভীরতায় মানুষ নামিয়ে কাজ করানো কি বিধিসম্মত? ইতিপূর্বে কলকাতা-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে যে শ্রমিকরা নিকাশি নালা বা সেপটিক ট্যাঙ্কে নেমে প্রাণ দিয়েছেন, সে সব ঘটনার পরে উঠে এসেছে ঠিক এই বিচ্যুতিগুলিই— মাটি-কাটা মজুর বা নির্মাণ শ্রমিককে কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই গভীর নালায় নামানো, সামান্যতম সুরক্ষা সরঞ্জামের জোগান না থাকা, নালায় বিষাক্ত বাষ্পের উপস্থিতি পরীক্ষা না করা, ইত্যাদি। এক জন শ্রমিক তলিয়ে গেলে তাঁকে উদ্ধার করার চেষ্টায় আরও কয়েকজনের প্রবেশ এবং মৃত্যু, এই ঘটনাক্রমও বার বার দেখা গিয়েছে। আরও দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে ঠিকাদারের তত্ত্বাবধানে। ফলে প্রকৃত নিয়োগকারী— কখনও তা পুরসভা, কখনও কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা, বৃহৎ আবাসন বা ব্যক্তি— দায় এড়িয়েছে। দায়িত্ব অস্বীকার করা এত সহজ বলেই এমন অবাধে চলছে নিকাশি নালায় শ্রমিকদের প্রবেশ করানোর অপরাধ। কয়েক বছর পর পর দুর্ঘটনাগুলি সামনে আসে বটে— চার বছর আগে কলকাতার কুঁদঘাটে একটি ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশনে পর পর সাত জন শ্রমিক তলিয়ে গিয়েছিলেন— কিন্তু নালা-নর্দমা সাফ করতে শ্রমিকের ব্যবহারে কোনও ছেদ পড়েনি।
সেপটিক ট্যাঙ্ক বা নিকাশি নালা পরিষ্কার করার জন্য মানুষকে ব্যবহার করা যাবে না, এই আইন ২০১৩ সালেই পাশ হয়েছে। তার পরেও ওই কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের মৃত্যুমিছিল অপ্রতিহত। ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ১১৭ জনের। ২০২৩ সালের মার্চ-এপ্রিলে গুজরাতে আট জন, মে মাসে উত্তরপ্রদেশে আট জন এবং দিল্লিতে চার জন শ্রমিক মারা যান। এঁরা সকলেই প্রশিক্ষণহীন, সুরক্ষা-সরঞ্জামহীন অবস্থায় নীচে নেমেছিলেন। ২০১৬-২০২৩ সালের মধ্যে তিনশোরও বেশি শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন সরকারি হিসাবে, যদিও অসরকারি সূত্র অনুসারে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। এমন ঘটনার প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্ট শ্রমিক-সুরক্ষার জন্য বিধি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। অপরাধের গুরুত্ব বোঝাতে মানববর্জ্য অপসারণ বা নালা-নর্দমা সাফ করতে গিয়ে শ্রমিক-মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছে ত্রিশ লক্ষ টাকা। তবে কত জন শ্রমিক বাস্তবিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, সে আর এক তদন্তের বিষয়। সংবাদে প্রকাশ, কুঁদঘাটের দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতরা এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি।
আইন অনুসারে, ঠিকাদারের অধীনে নিযুক্ত শ্রমিকের দুর্ঘটনা বা মৃত্যু ঘটলে মূল নিয়োগকারী তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে (এমপ্লয়িজ় কমপেনসেশন অ্যাক্ট, ১৯২৩)। আদালতও মূল নিয়োগকারীর দায় মনে করিয়ে নানা রায় দিয়েছে। অতএব ঠিকাদারের উপর দায় চাপিয়ে পুরসভা বাঁচতে পারে না। ঠিকাদার শ্রমিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে কি না, আইন মেনে কাজ করছে কি না, তার নজরদারি পুরসভারই দায়িত্ব। দরিদ্র শ্রমিকের অসহায়তা, এবং আদালতের দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায় এড়ানো সহজ হচ্ছে। তার খেসারত দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের, প্রাণের মূল্যে। শ্রমিক-সুরক্ষায় অবহেলার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে পরের দুর্ঘটনা কেবল কয়েক মাস, বা বছরের অপেক্ষা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)