রাজনীতি পাল্টাইলেও মানসিকতা পাল্টায় না। ভারতবর্ষে এই সারসত্যটি অতি-ব্যবহারে স্বাভাবিক হইয়া আসিতেছে। যে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যেখানে, সেখানে তাহার অপ্রিয় কথা বলা চলিবে না, ইহাও স্বাভাবিক হইতেছে। দরকারে কোপ পড়িবে সংস্কৃতি জগতের উপরেও। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের উপর শাসকের আক্রমণের উদাহরণ অনেক। হার্বার্ট, পশুখামার, ভবিষ্যতের ভূত সংক্রান্ত বিতর্কের কলঙ্কিত ঐতিহ্য রাজ্যবাসীর মনে থাকিবার কথা। অবশ্য এই সব ক্ষেত্রেই, শাসকের রোষ ধাবিত হইয়াছিল ইহাদের প্রতি। এখন কিন্তু দেখা যাইতেছে, বিরোধী রাজনীতির হম্বিতম্বিও একই মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে। কিছু স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ পাইলে বিরোধী দলও এই রাজ্যে নিজের সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ পাকা করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িতে পারে, প্রমাণ করিল বিজেপি। বিগত সপ্তাহে সুন্দরবনের বাসন্তীর এক মাঠে ইঁদুরকল নাটকের অভিনয় আয়োজিত হইয়াছিল, প্রদর্শিত হইয়াছিল কেন্দ্রীয় সরকার-বিরোধী পোস্টারও। অতঃপর বিজেপির পঞ্চায়েত সদস্য ও স্থানীয় ক্লাবের সদস্যগণ কর্তৃক প্রাণনাশের হুমকি, নাট্যাঙ্গনে হামলা, পোস্টার ছেড়া এবং কলিকাতার পরবর্তী শো বাতিল। অর্থাৎ, রাজ্যের বিরোধী দল ইতিমধ্যেই রাজ্যে তাহাদের নিয়ন্ত্রিত পরিসরে বলপূর্বক মত দমন করিতে নামিয়াছে। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, বিরোধী হিসাবেই যাহারা এমন করিতে পারে, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের ভাগ তাহাদের পক্ষে বেশি পড়িলে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি জগতের দিশাটি কেমন হইতে বসিবে।
শুধু বিজেপি নহে, এই দোষে পশ্চিমবঙ্গ তাহার সকল রাজনৈতিক দলকেই দুষ্ট হইতে দেখিয়াছে। ২০০১ সালে দলের ছাত্র-যুব সংগঠনের প্রতিবাদের মুখে কলকাতা ফিল্মোৎসব হইতে প্রত্যাহৃত হইয়াছিল আলেকসান্দর সকুরোভ নির্মিত চলচ্চিত্র টরাস। দুঃখপ্রকাশের প্রশ্নই নাই, লেনিনকে লইয়া তথ্যবিকৃতির অভিযোগকে ঢাল করিয়াছিলেন বাম নেতা বিমান বসু। অভিযোগ শুনা যায়, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে সরকার বিরোধী নাট্য-ব্যক্তিত্বদের কল শোয়ের সংখ্যায় মারাত্মক প্রভাব পড়িয়াছিল। স্টার থিয়েটারে তিন কন্যা চলচ্চিত্রের প্রদর্শন বন্ধের অধ্যায়টিও বহু বাঙালিই বিস্মৃত হন নাই। মতাদর্শে সওয়ার হইয়া শিল্পকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অধিকার নিশ্চয়ই আছে রাজনৈতিক দলগুলির, কিন্তু বলপ্রয়োগের অধিকার আছে কি? বাক্স্বাধীনতার কোন ধারায় প্রতিবাদী শিল্পসৃষ্টি বন্ধ করা যায়? রাজনীতির যদি মত প্রকাশের অধিকার থাকে, শিল্পের থাকিবে না কেন? দ্বিতীয়ত, দলীয় পার্টি কর্মসূচি লইতেই পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক মতে গঠিত ক্ষমতা দিয়া এই ভাবে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা যাইতে পারে কি?
ঘরপোড়া রাজ্যের নিকট স্বৈরাচারের সিঁদুরে মেঘ স্বাভাবিক ভাবেই অতীব উদ্বেগজনক। যে রাজনীতি ভাবে, সরকার-পোষিত জ্ঞানই যথেষ্ট, তাই বৌদ্ধিক বৃত্তি বা সংস্কৃতির দরকার নাই— তাহাকে গণতন্ত্রের অর্থ বুঝানো দরকার। মনে করানো দরকার, রে ব্র্যাডবেরি-র ফারেনহাইট ৪৫১ উপন্যাসে জনতাকে দূরদর্শনে ব্যস্ত রাখিয়া পুস্তক-দহনযজ্ঞে ব্যস্ত ছিল কোন শাসকবাহিনী, কিংবা জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪, যেখানে বইয়ের অনুমোদন ছিল না। যে রাজনীতি শিল্পী তথা নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ করে, তাহাকে গণতান্ত্রিক বলা চলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy