এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা ছিল ১১ লক্ষেরও বেশি পরীক্ষার্থীর। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
যে অন্ধকারের বাস প্রদীপের ঠিক তলাটিতেই, তার দিকে নজর পড়ে না তত, সকলে ব্যস্ত থাকেন আলোকশিখাটুকু নিয়েই। সে কারণেই হয়তো, এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে সবাই কথা বলছেন সেই বিষয়গুলি নিয়েই, প্রতি বছরই যা আলোচনায় ঘুরেফিরে আসে: মেধাতালিকা, প্রথম দশে থাকা ছাত্রছাত্রী-সংখ্যার বাড়বৃদ্ধি, জীবনসংগ্রামে যুঝে বহু পড়ুয়ার সাফল্য অর্জন এবং অবশ্যই কলকাতা ‘বনাম’ জেলাগুলির লড়াই। সমাজজোড়া আলাপ-আলোচনায় শেষোক্ত বিষয়টি প্রায় নিয়মে পর্যবসিত, কেমন করে পাশের হারে পূর্ব মেদিনীপুর, বা প্রথম দশে সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিতে মালদহ জেলা কলকাতাকে হেলায় হারাল, এই খবর যে গুরুত্বে উদ্ভাসিত, মোটেই সে ভাবে আলোচিত নয় এই মুহূূর্তে রাজ্যের স্কুলগুলির বাস্তবচিত্র। কলকাতায় কত সংখ্যক ছাত্রছাত্রী রাজ্য বোর্ডের স্কুলগুলিতে পড়ে, সিবিএসই-আইসিএসই স্কুলগুলির প্রতি অভিভাবকরা কেন বেশি ঝুঁকে থাকেন, বোর্ড পরীক্ষার ফলাফলে জেলাগুলির জয়জয়কারের ব্যাখ্যা কি আসলে রাজ্য বোর্ডের উপর আন্তরিক নির্ভরতা, না কি অন্য বোর্ডের ব্যয়বহুল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে ছেলেমেয়েদের পড়াতে না পারার অপারগতা— এই আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে বরং কথা হওয়ার ছিল। হয়নি।
এহ বাহ্য। এ বছরের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফলে একাধিক তথ্য-পরিসংখ্যান রীতিমতো অস্বস্তির। প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেছে সমস্ত পরীক্ষার্থীর মাত্র ১৩.৬ শতাংশ, এই ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই শিউরে ওঠার মতো তথ্য চোখের সামনে— ছয় লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফেল করেছে এক লক্ষেরও বেশি! শুধু স্কুলশিক্ষা দফতরেরই নয়, সার্বিক ভাবে সমগ্র রাজ্য সরকারেরই এ বিষয়ে অবিলম্বে আলোচনায় বসার দরকার ছিল, প্রয়োজন ছিল আত্মসমীক্ষার: কেন মাধ্যমিকের ফলাফলে প্রদীপের নীচের অন্ধকার এত বেশি গাঢ়? ২০২০-২০২১ জুড়ে কোভিড-অতিমারির দাপট যে স্কুলশিক্ষায় দুরপনেয় দাগ রেখে গেছে তা আগেই প্রমাণিত; উঁচু ক্লাসের অজস্র ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট হয়েছে, পরিবারের অন্ন-সংস্থানের কাজে লেগে পড়ায় বইখাতা ভুলতে বাধ্য হয়েছে, পরীক্ষার উপযুক্ত প্রস্তুতিটুকুও নিতে পারেনি। কিন্তু সরকারের তরফেও এমন সহমর্মিতা ও সক্রিয়তা চোখে পড়েনি যাতে কোভিড-উত্তর স্কুলশিক্ষায় এই বিরাট ক্ষতি পূরণ হয়।
শেক্সপিয়রের নাটকের অনুসরণে বলতে হয়, এ রাজ্যে কিছু একটা পচেছে। সেটি কী তা সকলেরই জানা, সামগ্রিক ভাবে স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থাটিই আজ এ রাজ্যে ধসের মুখে। অতিমারি থেকে লব্ধ জীবনশিক্ষাগুলি স্কুলশিক্ষায় তো কাজে লাগানো হয়ইনি, উপরন্তু সামনে এসেছে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরে স্কুলশিক্ষক নিয়োগে সরকারের প্রবল দুর্নীতি। প্রায়োগিক স্তরে তার বিরুদ্ধপ্রভাব পড়েছে রাজ্য জুড়ে স্কুলগুলির দৈনন্দিন পরিচালনায়, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায়, ছাত্র ও শিক্ষক এবং শিক্ষক ও বৃহত্তর সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কে। এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল খতিয়ে দেখলে এই সব অভিঘাতই বিলক্ষণ বোঝা যাবে। অবশ্য খতিয়ে দেখবেই বা কে। পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশের চ্যালেঞ্জ উতরানো, সফল পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মাতামাতিতেই সরকারের উৎসাহ, প্রদীপের তলার অন্ধকার ঘন হলেই বা কী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy