অরুন্ধতী রায়। —ফাইল চিত্র।
অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ইউএপিএ-র অধীনে মামলা শুরু করার অনুমতি পেল দিল্লি পুলিশ। এ হল সেই গোত্রের মামলা, যেখানে অভিযুক্তের চাইতে তদন্তকারীকে নিয়ে দেশের মানুষের মনে সংশয় জাগে বেশি। চোদ্দো বছর আগে অরুন্ধতী একটি বক্তৃতায় কাশ্মীর বিষয়ে কিছু মত প্রকাশ করেছিলেন, যাকে ‘প্ররোচনামূলক’ বলে পুলিশে নালিশ করেছিলেন এক ব্যক্তি। এর প্রেক্ষিতে দিল্লি পুলিশ অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় মামলা রুজু করেছে, এবং তদন্ত করছে। যথাসময়ে তদন্ত শেষ করতে না পারায় কয়েকটি মামলা তামাদিও হয়ে গিয়েছে। সর্বোপরি, অরুন্ধতীর ওই মন্তব্যের ফলে কাশ্মীরে অস্থিরতার নিদর্শন মিলেছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের কোনও সংযোগ মিলেছে তাঁর বক্তব্যের, এমন কোনও প্রমাণ আদালতে কখনও পেশ করা হয়নি, জনসমক্ষেও আসেনি। বরং এ বছরের সাধারণ নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ ভাবেই ভোট হয়েছে কাশ্মীরে। এর মধ্যে এমন কী নতুন সাক্ষ্যপ্রমাণ খুঁজে পেল পুলিশ, যার ভিত্তিতে চোদ্দো বছর আগে একটি বক্তৃতার জন্য ইউএপিএ-র মতো কঠোর ধারা আরোপ করার দরকার হল? সে বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করেনি পুলিশ। অতএব যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হল, এই ধারার প্রয়োগ কি ন্যায়বিচারের প্রয়োজনে, না কি রাজনৈতিক? নরেন্দ্র মোদী সরকার যে ভাবে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং রাষ্ট্রদ্রোহবিরোধী আইনকে সমালোচকদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করে তুলেছে, তাতে এ আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয়। রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-২০২০ সময়কালে চব্বিশ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির উপরে ইউএপিএ আরোপ হয়েছিল, তাঁদের সাতানব্বই শতাংশই জেলবন্দি হয়ে আছেন, অপরাধী প্রমাণ হয়েছেন ২১২ জন। কারণ, এই মামলায় জামিন পাওয়া
প্রায় অসম্ভব।
নানা সময়ে প্রাপ্ত তথ্য দেখাচ্ছে, ইউএপিএ-র অধিকাংশ মামলায় চার্জশিট ফাইল করার প্রতীক্ষা চলছে। আশঙ্কা, অপরাধীর বিচার নয়, নিরপরাধ সমালোচককে শাস্তি দেওয়াই উদ্দেশ্য। এ ভাবে বিরোধিতাকে ‘অপরাধ’ করে তোলার প্রবণতা সারা বিশ্বে সমালোচিত হয়েছিল। এ বারের নির্বাচনে বিজেপির আসন কমার পরে অনেকে মনে করেছিলেন, মোদী সরকার কঠোর আইনের নির্বিচার প্রয়োগের বিষয়ে সতর্ক হবে। সুপ্রিম কোর্ট ২০২২ সালেই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগে রাশ টেনেছে। চুরাশি বছরের ফাদার স্ট্যান স্বামীর জেলেই মৃত্যু (২০২১), কিংবা সম্প্রতি নিউজ়ক্লিকের কর্ণধার প্রবীর পুরকায়স্থ আদালতে নিঃশর্তে মুক্তি পাওয়ার পরে ইউএপিএ-র উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। এর পরেও যে দিল্লির উপরাজ্যপাল সাক্সেনা অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগের অনুমোদন দিলেন, তা একটি সঙ্কেত— বাক্স্বাধীনতাকে কঠোর ভাবে দমন করার অবস্থানে মোদী সরকার অনড়।
গণতন্ত্রের প্রতি ভারতের বর্তমান শাসকদের শ্রদ্ধাবোধ প্রখর, এমন কথা গত দশ বছরে খুব কেউ বলেননি। প্রশ্ন হল, শাসক যদি গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তগুলিকে অবজ্ঞা করতে চায়, বাক্স্বাধীনতার মতো সংবিধানসিদ্ধ অধিকারকে খর্ব করতে উদ্যত হয়, তাকে সংহত করার দায়িত্বটি কার? শাসনবিভাগ ও পুলিশ সেই দায়িত্ব পালনে বারংবার ব্যর্থ হয়েছে, হয়েই চলেছে। আশার কথা, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে বিচারবিভাগ রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই অবস্থায় গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষার দায়িত্ব যেমন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির উপরে বর্তায়, তেমনই সে দায়িত্ব নাগরিক সমাজেরও। নির্বাচন চুকলেও সে দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়নি, বরং তীব্রতর হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে শাসকদের উপর নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করে যেতে হবে। গণতন্ত্রহীনতার যে অসম্মান ভারত বিশ্বমঞ্চে অর্জন করছে, সেই লজ্জা ঘোচানোর দায়িত্ব নিতেই হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy