Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Mamata Banerjee

অনস্বীকার্য

২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তৎকালীন বিরোধী নেত্রী যখন সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর জন্য জীবন পণ করেছিলেন, তখন তাঁর কাছে মাছের চোখ ছিল রাজ্যের মসনদ।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২২ ০৬:০৭
Share: Save:

সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।”— অধুনা ভারতীয় রাজনীতির মূলমন্ত্র এই কথাটি। অবশ্য, বাল্মীকির মতোই, নেতাদের মনেও এ-হেন সংশয় ছিল যে, “পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, এই ভয় জাগে মোর মনে”, এমন দাবি করার প্রশ্নই নেই। তাঁরা নির্দ্বিধ, নিঃসঙ্কোচ— ইতিহাস যদি তাঁদের মনমতো না হয়, তবে তাঁরা নতুন করে ইতিহাস রচনা করেন। এই ক্ষেত্রে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি থেকে বামপন্থী, সবাইকে গোল দিয়েছেন। নতুন করে ইতিহাস লেখার সময় বিজেপি নেতাদের অন্তত দাবি করতে হয় যে, পুরনো ইতিহাসে থাকা ভ্রান্তিগুলি অন্যদের ষড়যন্ত্র। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সওদাগরদের জাতীয়তাবাদী হিসাবে, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রণী সৈনিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে বলতে হয়, নেহরু পরিবারের তোষামোদকারী ইতিহাসবিদরা ইচ্ছা করে তাঁদের কথা উল্লেখ করেননি। অথবা, রাজপুতদের হাতে মোগলদের সমূহ পরাভবের কথা ইতিহাস বইয়ে ঢোকাতে হলে বলতে হয়, আগের বইগুলো মুসলমান-তোষণকারীরা লিখেছিল বলেই তাতে সত্য ইতিহাস নেই। বামপন্থীদেরও যেমন ঢোঁক গিলে প্রমাণ করতে হয় যে, সুভাষচন্দ্র বসু সম্বন্ধে তাঁরা মন্দ কথা বলেননি, ‘মানুষের বুঝতে ভুল হয়েছিল’। কিন্তু, শিলিগুড়ির সভায় মুখ্যমন্ত্রী যে ইতিহাস অস্বীকার করলেন, তা আক্ষরিক অর্থেই তাঁর দলের লেখা। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা সিঙ্গুর আন্দোলনের কথা ইতিহাসের পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত করেন। এখন দলে ও দলের বাইরে, জেলে ও জেলের বাইরে থাকা বহু নেতার কথা ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার আগে দুলে দুলে মুখস্থ করে— কী ভাবে তাঁরা সিঙ্গুরের মাটিকে দখলমুক্ত করেছিলেন, সেই বীরগাথা। এখন মুখ্যমন্ত্রী যদি সিঙ্গুর থেকে টাটা ন্যানোর কারখানা তাড়ানোর দায়টি সিপিএম-এর ঘাড়ে চাপিয়ে দেন, তা হলে ছাত্ররা মুশকিলে পড়বে। অবশ্য, বই পাল্টে দিলে অন্য কথা।

এই দায় আজ সিপিএম-এর ঘাড়ে চাপাতে হচ্ছে কেন, সেই প্রশ্নটি অবশ্য স্কুলপাঠ্য বইয়ের মাপে আঁটবে না। ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তৎকালীন বিরোধী নেত্রী যখন সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর জন্য জীবন পণ করেছিলেন, তখন তাঁর কাছে মাছের চোখ ছিল রাজ্যের মসনদ। তার জন্য তিনি কোন মূল্য দিচ্ছেন, সেই হিসাবটি তিনি কষেননি। অথবা, তাকে গুরুত্ব দেননি। অবিবেচনা, সন্দেহ নেই— কারণ, বিরোধী নেত্রী হিসাবে রাজ্যের শিল্পায়ন বা কর্মসংস্থানের কথা যদি তিনি না-ও বা ভাবেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সে কথা যে তাঁকে ভাবতেই হবে, এই সাধারণ কথাটি তিনি স্মরণে রাখলে পারতেন। বামপন্থীরা বহু শ্রমে, বহু বছরের অবিমৃশ্যকারিতায় রাজ্যকে শিল্পহীন করেছিলেন, মানুষের মনে শিল্প সম্বন্ধে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই অবিশ্বাস, সেই ভীতিকেই নিজের রাজনৈতিক পুঁজিতে পরিণত করেছিলেন। আজ তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন যে, কাজটি ঠিক হয়নি। রাজ্যে শিল্প না থাকলে, কর্মসংস্থানের পরিসরটুকুই না থাকলে শুধু সরকারি সাহায্যে মানুষের দিন চলে না। পশ্চিমবঙ্গে আজ সিন্ডিকেট নামক দুর্নীতির যে সর্বগ্রাসী ব্যবস্থাটির পূর্ণগ্রাস, তার মূলগত কারণ হল, এ রাজ্যে বৈধ পথে অর্থোপার্জনের সুযোগ অতি সীমিত। এই রাজনৈতিক দায় বহন করা কঠিন। অতএব মুখ্যমন্ত্রী ইতিহাস পাল্টে দিতে চান। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের পাপের বহর নেহাত কম নয়— রাজ্যকে শিল্পশ্মশানে পরিণত করার দায়টি বহুলাংশে তাঁদের। যুক্তফ্রন্ট আমলের ‘ঘেরাও মন্ত্রী’ সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা রাজ্য ভুলবে কী করে? কিন্তু টাটা ন্যানোর কারখানাটিকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করার দায়টি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বহন করতে হবে। তিনি প্রায়শ্চিত্ত করবেন, না কি অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টাতেই সীমাবদ্ধ থাকবেন, তা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন।

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee TATA Singur TMC CPM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy