কোন জায়গায় কোন সময়ে কোন কথাটি বললে কাজ হবে, সে কথা জেনে রাখা বাগ্মী বা মতান্তরে বাক্যবাগীশের অবশ্যকর্তব্য। কোন কথাটি বলতে হবে না, বা চেপে যেতে হবে সুকৌশলে, তা-ও। বিহারে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধনে নরেন্দ্র মোদীর এই ‘সুভাষিত’ প্রভূত প্রচার পেয়েছে: আগুনে বই পুড়ে যেতে পারে, কিন্তু জ্ঞানকে পোড়ানো যায় না। ইঙ্গিতটি প্রাচীন নালন্দাকে মনে করায়— সাত-আটশো বছর ধরে বৌদ্ধধর্ম ও সারস্বত চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের পর এই মহাবিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ধ্বংস’ হয় ‘বহিরাগত’ আক্রমণে, জনপরিসরে চালু এই ধারণারই সমর্থন করে। সুদূর অতীতে খ্যাতি ও সাফল্যের শিখরে ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়, বিজেপির তৃতীয় দফার শাসনে আবার সে এসেছে ফিরিয়া— এটাই তো গৌরবের। এ-ই তো প্রত্যক্ষ প্রমাণ— জ্ঞানকে পোড়ানো যায় না!
প্রধানমন্ত্রী মুখে যে উচ্চমার্গীয় কথাগুলি বলেন, মনে তা-ই বিশ্বাস করেন কি? ‘মন কি বাত’ সে কথা বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। এ-হেন পরিস্থিতিতে প্রমাণ হয়ে দাঁড়াতে পারত তাঁর ও তাঁর দলের এবং সরকারের কাজ ও আচরণ— সেও যে খুব সুবিধার নয়, এই সময়ই তার প্রমাণ। বিজেপির শাসনকালে বই পুড়ছে না এটুকুই যা তফাত, তবে বইয়ের বয়ান পাল্টে যাচ্ছে নিয়ম করে। বিজেপির আইটি সেল যখন ‘বহিরাগত বিধর্মীর আক্রমণে ধ্বংস হওয়া প্রাচীন নালন্দার গৌরবময় পুনরাবির্ভাব’-এর বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশ জুড়ে, সেই সময়েই মনে রাখা দরকার, গত দশ বছরে এনসিইআরটি-র স্কুলপাঠ্য বইয়ের বয়ান পাল্টেছে চার বার। সাম্প্রতিকতম উদাহরণটি মাত্র ক’দিন আগের, দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইয়ে বাবরি মসজিদ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘তিন গম্বুজবিশিষ্ট সৌধ’; অযোধ্যা সংক্রান্ত অধ্যায় চার থেকে কমে হয়েছে দু’পাতা; মুছে ফেলা হয়েছে মসজিদ ধ্বংসের নানা তথ্য: করসেবকদের ভূমিকা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা; আদালতের রামমন্দির নির্মাণের নির্দেশ সম্পর্কে লেখা হয়েছে ঘটা করে। জ্ঞান পোড়ানো যায় না বটে, তবে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহারে কী ভাবে ইতিহাসের সত্য ও পাথুরে প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করা যায়, এ-ই কি তার প্রমাণ নয়? বিজ্ঞান-বইয়ে ডারউইন ও বিবর্তনবাদে হাত, অঙ্কে বৈদিক গণিতকে জবরদস্তি অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা নাহয় বাদই দেওয়া গেল।
এ কালে, বিশেষত ‘অমৃতকাল’-এর ভারতে বই পোড়ানো সমস্যার, জ্ঞান-চর্চা কুক্ষিগত করা বরং সহজ। সেই কাজই হয়ে চলেছে নানা ভাবে: রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহারে, পাশাপাশি সমাজমাধ্যম ও জনমানসে ভুল ধারণা ও ভুয়ো তথ্যের প্রচারে। বিজেপির আইটি সেল-এর দৌলতে এরই মধ্যে ‘নতুন’ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন হয়ে দাঁড়িয়েছে বহিরাগত বিধর্মীর ধ্বংস অগ্রাহ্য করে প্রাচীন নালন্দার নবজাগরণ; নব-নালন্দার উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রীর মুখে ‘নবজাগরণ’ শব্দটির ব্যবহারও লক্ষণীয়। অথচ তিনি অনুষ্ঠানে এক বারও উচ্চারণ করেননি প্রতিষ্ঠাতা আচার্য অমর্ত্য সেনের নাম। এখন জানা যাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন-সমিতি সরকারি লোকে ভরা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মানুষই সেখানে সংখ্যালঘু; বিহারের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তার স্থান এক সমীক্ষামতে ১৯ নম্বরে! উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ‘জ্ঞান অদাহ্য’ বলে গর্ব করা প্রধানমন্ত্রী এই সব প্রকৃত তথ্য জানার পরেও খুব গর্ববোধ করবেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy