মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প (মনরেগা) থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, তা সংসদে জানাল কেন্দ্রীয় সরকার। একটি প্রশ্নের উত্তরে সরকার জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ সালে ওই প্রকল্পে কাজ পাওয়া পরিবারের সংখ্যা এ রাজ্যে শূন্য। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সাংসদরা দাবি করেছেন, এ হল পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রের রাজনৈতিক বঞ্চনার প্রমাণ। আর কেন্দ্র ফের অনিয়মের অভিযোগকে সামনে এনেছে। বলেছে, পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতি হয়েছে, তাই মনরেগার টাকা দেওয়া হবে না। এই পরিণামহীন, যুক্তিহীন বিতর্ক যেমন বিরক্তিকর, তেমনই অন্যায়। মনরেগা একটি আইন, যা সংসদে পাশ করা হয়েছে। ভারতের যে প্রান্তে যত মানুষ কর্মপ্রার্থী, সেখানেই তত মানুষকে কাজ দিতে কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকার দায়বদ্ধ। যদি দিতে না পারে, তা হলে দিতে হবে বেকার ভাতা। কাজ, অথবা বেকার ভাতা, এগুলি পাওয়ার অধিকার রাষ্ট্র দিয়েছে নাগরিককে। ‘অধিকার’ সর্বদাই শর্তহীন, কোনও কারণেই তাকে খর্ব করা চলে না। অতএব ‘দুর্নীতি হলে টাকা দেব না’— কেন্দ্রের এই দাবি বেআইনি এবং অনৈতিক। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকের অধিকারের সুরক্ষা কি কেন্দ্রের কাজ নয়? যদি ধরে নেওয়া যায় যে, রাজ্য সরকার ওই টাকা নয়ছয় করেছে, তা হলেও কেন্দ্রের দায় লাঘব হয় না। সরকারি টাকার অপব্যবহার কী করে থামানো যায়, কী করে শৃঙ্খলা আনা যায় হিসাবে, তা নির্ধারণ করার মতো দক্ষ প্রশাসক কি কেন্দ্রীয় সরকারের নেই? দু’বছরের অধিক সময় পার করেও একটি প্রকল্পের হিসাবে স্বচ্ছতা আনা গেল না, বকেয়া মজুরি মেটানো গেল না, নতুন করে কাজ শুরু করা গেল না কেন, তার কোনও সদুত্তর কেন্দ্রীয় সরকার কখনও দেয়নি, আজও দিল না।
সংসদ বিরোধীর সঙ্গে ঝগড়ার জমি নয়, তা নাগরিকের কাছে তার নির্বাচিত সরকারের জবাবদিহির কক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কেন তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, বিরোধী দলের প্রতি বিদ্রুপ, ব্যঙ্গোক্তি ছুড়ে তার উত্তর দেওয়ার দায় থেকে কেন্দ্র মুক্তি পাবে না। তেমনই, তৃণমূল সরকারও প্রকল্প-বঞ্চনাকে কেবলমাত্র কেন্দ্রের রাজনৈতিক বৈষম্য বলে দেখিয়ে পার পাবে না। প্রকল্পের টাকা রাজ্যে নিয়ে আসতে না-পারা রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। পশ্চিমবঙ্গই ভারতের একমাত্র বিরোধী রাজ্য নয়। অথচ, কেবল পশ্চিমবঙ্গেই মনরেগা বন্ধ হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধিতাকে বার বার প্রশাসনিক অসহযোগিতায় নিয়ে যাওয়ার যে নজির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার স্থাপন করছে, তা অন্য কোনও রাজ্যে দেখা যায় না। প্রায় প্রতিটি উন্নয়ন বা অনুদান প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য কাজিয়ার জেরে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রের অর্থ বরাদ্দ ব্যাহত হয়েছে। বর্তমানে একশো দিনের কাজ এবং আবাস যোজনায় টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র।
অধিকারের সুরক্ষা, উন্নয়নে সহায়তা, এ দুটো যে রাজনৈতিক মত-নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের পাওয়ার কথা, এ কথাটা কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারই ভুলতে বসেছে। সরকারি বরাদ্দ প্রদানকে সমর্থনের পুরস্কার, আর বরাদ্দ বাতিলকে শাস্তি হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে নাগরিক। এর ফল ভয়াবহ। কেবল মনরেগার কাজ হারানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে গিয়েছে। মনরেগার কাজে সমমজুরি মিলত মেয়েদের, তা বন্ধ হওয়ায় মেয়েদের মজুরিতে বৈষম্যও বাড়ছে। গ্রামের পরিকাঠামো উন্নয়নের যে সব কাজ মনরেগার অধীনে হত, সেগুলিও বন্ধ। রাজ্য সরকার ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্প ঘোষণা করেছে, কিন্তু তা সরকারি প্রকল্পই, অধিকার নয়। তা কখনওই ব্যাপকতায়, বরাদ্দে, মনরেগার সমতুল হতে পারবে না। রাজনৈতিক বিবাদ মিটিয়ে মনরেগা চালু না করলে পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র, শ্রমজীবী নারীপুরুষের অধিকার ভঙ্গের দায় স্বীকার করতে হবে রাজ্য ও কেন্দ্র, দুই সরকারকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy