পঁয়ষট্টি বছর আগের সেই ছবিটি: ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন করছেন বুধনি মাঝি নামে এক সাঁওতাল মেয়ে, পঞ্চদশবর্ষীয়া। পাশে দাঁড়িয়ে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মুখ তাঁর স্পষ্টতই প্রসন্নতার গৌরবে উজ্জ্বল। কেবল তাঁর মুখ নয়, প্রসন্নতা আর আশাবাদ সেই সময় ঝলমল করছিল অনেক ভারতবাসীর মনেই, ভাবা হচ্ছিল দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন থেকে একের পর এক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ভারী শিল্প, খনিজ শিল্পের উদ্বোধন— পাঞ্চেত, দুর্গাপুর, কোডার্মা, চন্দ্রপুরা, সাতনা, চিত্তরঞ্জন, রানিগঞ্জ, সব মিলিয়ে পূর্ব ভারতের মানচিত্রই যাবে পাল্টে, উন্নয়ন ঝেঁপে আসবে ক্রমে। ভাবতে ইচ্ছে করে, বুধনি যখন ফিরে গেলেন তাঁর গ্রামে, যেখানে তাঁকে বলা হল নেহরুকে মালা পরিয়েছেন মানেই আসলে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, তিনি আর সেই সম্প্রদায়ের কেউ নন, কী মনে হয়েছিল তাঁর। এ কথা জানা আছে যে অতঃপর পাঞ্চেতেই আশ্রয় নেন সেই মেয়ে, ডিভিসিতে কাজ পান, সুধীর দত্ত বলে এক জনের সঙ্গে সম্পর্করচনার ফলে এক কন্যাসন্তান জন্মায় তাঁর। কিন্তু তবু তিনি ও তাঁর কন্যা থেকে যান সমাজের প্রান্তেই। বাঁধ উদ্বোধনের প্রহরে আমন্ত্রণ জানানোর সময়ে বুধনির ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে বোঝেনি নেহরুর ভারত। ঠিক যেমন, ‘নতুন ভারতের মন্দির’ দামোদর নদীবাঁধ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও রূপায়ণের সময়ে বিস্তীর্ণ নদী-উপত্যকা ও অনাগত ভবিষ্যতের লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্যকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, সেই ভারত বোঝেনি তাও। বোঝেনি, প্রতি বছর নিয়ম করে বাঁধ থেকে ছাড়া জলে তলিয়ে যাবেন তাঁরা, বাড়িঘর, জমিজমা, গরুমোষছাগল, যেটুকু যা স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে তাঁদের, হারিয়ে ফেলবেন বাৎসরিক রীতিতে। হয়তো প্রাণহানি ঘটবে কোনও কোনও বছর, হয়তো প্রাণের ভয়ে বাকি বছরটা ঘুমোতে পারবেন না শান্তিতে। কিন্তু এ সব কিছুই না জেনে যে উন্নয়নের স্বপ্ন ও আশা উন্নতশিরে পথ হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিল, থেকে যাবে অব্যাহত, অকুণ্ঠিত। গত পঁচাত্তর বছরে যে সংখ্যক নদীবাঁধ তৈরি হয়েছে ভারতে, চিন ও আমেরিকা ছাড়া খুব বেশি দেশ তাকে স্পর্শ করার জায়গায় নেই।
টেনেসি ভ্যালি কর্পোরেশন-কে অনুসরণ করে ডিভিসি নদীবাঁধ প্রকল্প তৈরি শুরু হয়েছিল, তা স্কুলপাঠ্য ইতিহাস হয়ে আছে। কিন্তু পরিবেশবিদ্যা যে-হেতু ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ গভীরে পড়ানো হয় না, হয়তো তারা জানতে পারে না যে পরবর্তী কালে ইউরোপের বহু জায়গায় বড় বাঁধের বিপদ নিয়ে গবেষণা ও প্রচার হয়েছে, বেশ কিছু বড় বাঁধ সরানোর কাজও হয়েছে। বড় বাঁধ যে মানবজীবন ও বাস্তুতন্ত্রের কত বিপুল ক্ষতি সাধন করে, ডিভিসির প্রতি বছরের বন্যায় যে জনসমাজ ভাসে, সে সব কথা রাজনীতির বিষয় হয়ে থেকে গিয়েছে, অর্থনীতি বা উন্নয়নচিন্তায় জায়গা পায়নি। পরবর্তী কালে নর্মদা নদীবাঁধ আন্দোলন হয়েছে এ দেশে, কিন্তু যে বিপদ ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে, তা কমানোর যথাযোগ্য চেষ্টা হয়নি। অথচ কেবল তো দেশের মানুষের যন্ত্রণা নয়, রাজনীতির যন্ত্রণাও কম ঘটেনি বাঁধকে কেন্দ্র করে। কাবেরীর জল নিয়ে দুই রাজ্যের দীর্ঘকালীন সংঘর্ষ, ফরাক্কা বাঁধ নিয়ে অন্য দুই রাজ্যের ও দুই দেশের তিক্ত সম্পর্ক, হীরাকুঁদ বাঁধ বিতর্ক: সমস্যার তালিকা বেশ দীর্ঘ। লক্ষণীয়, এই সব বাঁধের ফলে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছেন যাঁরা, তাঁরা জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ। তাঁদেরই সর্বোচ্চ দাম দিতে হয়েছে এই উন্নয়নের পরিকল্পনায়। পরবর্তী ইতিহাসের প্রতিফলনে বুধনির সে দিনের উপস্থিতি তাই প্রায় এক মহাকাব্যিক আলোকে নতুন করে উন্মোচিত হয়।
পরিবেশ বনাম উন্নয়ন বিতর্কে প্রথম বিষয়ের গুরুত্ব প্রবল ভাবে মেনেও বলতেই হবে, দ্বিতীয় বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। এক দিক থেকে নেহরু ঠিকই বুঝেছিলেন, উন্নয়নের দিকে হাঁটতেই হবে এই উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশকে। কিন্তু কিসের উন্নয়ন, কোন পথে উন্নয়ন, সেই ভাবনা সে দিনও সব দিক সমান ভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি, আজও হচ্ছে না। যাঁরা সমালোচনা করেছিলেন, যেমন সরকারি সেচ ও জলপথ বিভাগের মুখ্য বাস্তুকার কপিল ভট্টাচার্য, তাঁরা সে দিন তীব্র ভাবে সমালোচিত, এমনকি নিন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু সাড়ে সাত দশক পরে সমালোচনার অবকাশ আর নেই। রাজ্যে রাজ্যে দর-কষাকষি, কেন্দ্রে রাজ্যের লড়াই, এই সবই রাজনীতির মশলা। কিন্তু বানভাসি মানুষের আর্ত মুখচ্ছবি বলে, কেবল বাৎসরিক ত্রাণ আয়োজনই এর সমাধান হতে পারে না, আরও বেশি কিছু চাই। সেই বেশি কিছু দাবি করার সময়— আর কবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy