Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
Child Marriage

লজ্জার সংখ্যা

সম্প্রতি দেশের সব জেলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, নাবালিকা বিবাহের সর্বোচ্চ হার যে পাঁচটি জেলায়, তার তিনটি পশ্চিমবঙ্গে ও দু’টি বিহারে।

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:২৩
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহের সঙ্কট কত তীব্র, নানা সমীক্ষায় তা বার বার প্রকাশিত হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের সব জেলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, নাবালিকা বিবাহের সর্বোচ্চ হার যে পাঁচটি জেলায়, তার তিনটি পশ্চিমবঙ্গে ও দু’টি বিহারে। মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুরে জেলায় ৬২ থেকে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় আঠারো বছর বয়সের আগে। তথ্যটি অপ্রত্যাশিত নয়। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০১৯-২১) তথ্য দেখিয়েছিল যে, রাজ্যে আঠারো বছর বয়সের পূর্বে ৪১% মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, যা জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০, এই পাঁচ বছরে বাল্যবিবাহ বেড়েছে দশটি জেলায়। সাতটি জেলায় ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের গর্ভধারণের হার বেড়েছে। জাতীয় স্তরের এই সমীক্ষাকেই জেলা স্তরে বিশ্লেষণ করে একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় নাবালিকা বিবাহের হারের জেলাওয়ারি হার প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। এর ফলে নীতিনির্ধারক এবং প্রশাসকদের পক্ষে আরও নির্দিষ্ট ভাবে নাবালিকা বিবাহের সমাধান নির্মাণ ও রূপায়ণ সম্ভব হবে। কারণ, কয়েকটি জেলায় যে এই সঙ্কট কতখানি তীব্র, সেই সত্যটি রাজ্যের গড়, বা জাতীয় গড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। ভারতের ৭০৭টি জেলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, তেরোটি জেলায় ৬০ শতাংশের বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় আঠারো বছরের আগে। এগুলির মধ্যে বিহারের ন’টি এবং পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা রয়েছে। আরও ছিয়াশিটি জেলায় ওই হার ৪৯ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ভারতে নাবালিকা বিবাহের হার আগের চেয়ে কমলেও তাতে স্বস্তির কারণ নেই।

এই ব্যর্থতা বিশেষ ভাবে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে উদ্বেগজনক। কারণ ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেছে। কন্যাশ্রী প্রকল্পে ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৮,০০০ কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। ২০১৮ সালে ‘রূপশ্রী’ প্রকল্প বছরে ১,৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে শুরু হয়েছিল। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে, এই প্রকল্প দু’টি নাবালিকা বিবাহ এবং অকালমাতৃত্ব কমাতে পারেনি। বরং পুরুষতন্ত্রের প্রাবল্যের জন্য পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও, এবং নাবালিকা বিবাহ কমানোর জন্য কোনও বিশেষ উদ্যোগ না করা সত্ত্বেও, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে নাবালিকা বিবাহের হার দ্রুত কমেছে। ঠিক কী কারণে পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে নাবালিকা বিবাহের হার উত্তর ভারতের চাইতে বেশি, সে সম্পর্কে এখনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

দারিদ্র নিশ্চয়ই একটা কারণ, কিন্তু তা যে একমাত্র কারণ, এমনকি প্রধান কারণ না-ও হতে পারে, তারও ইঙ্গিত মেলে জেলাওয়ারি সমীক্ষায়। ইতিপূর্বে একটি বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, কলকাতার মতো অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ জেলাগুলিতে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে, পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুরের মতো দরিদ্র জেলায় কমেছে। অতএব কেবল পরিবারকে সরকারি অনুদান দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, তা স্পষ্ট। তাই কয়েকটি সম্ভাবনার কথা ভাবতে হবে। এক, পরিবারের পিতৃতান্ত্রিকতা। মেয়েদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সুযোগ দিতে এখনও নারাজ অধিকাংশ পরিবার। তাই নাবালিকা কন্যার বিয়ে দিচ্ছে, আবার কিশোরীদের পালিয়ে বিয়ে করার ঘটনাও বাড়ছে। দুই, বিকল্পের অভাব। কিশোরীদের সামনে কর্মনিযুক্তি, রোজগারের সম্ভাবনা সে ভাবে পরিস্ফুট হচ্ছে না। গার্হস্থ জীবনই অবধারিত, বা প্রার্থিত মনে করছে তারা। তিন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের আধিক্য। অতএব কেবল আঠারো বছর পার করার সূচকের দিকে লক্ষ্য রাখলে হবে না, লক্ষ্য হতে হবে মেয়েদের সক্ষমতা। তার জন্য একমুখী প্রকল্প নয়, বহুমাত্রিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

Child Marriage West Bengal Child Safety
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE