রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।
হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির মধ্যে অপরিচয়ের বীজকে নানা ভাবে উস্কে দেওয়া ও কোনও এক পক্ষের ধর্মীয় চিহ্নকে সুপরিকল্পিত ভাবে সুবৃহৎ করে চোখের সামনে তুলে ধরাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রধান অস্ত্র। এই অস্ত্রের বিরুদ্ধে পারস্পরিক সুপরিচয়ের সংস্কৃতিই যথার্থ ঢাল হয়ে উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান যখন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, পরস্পরের সুখ-দুঃখ নানা সূত্রে বিজড়িত, একের গৃহে অগ্নি লাগিলে অন্যকে যখন জল আনিতে ছুটাছুটি করিতে হয়, তখন শিশুকাল হইতে সকল বিষয়েই পরস্পরের সম্পূর্ণ পরিচয় থাকা চাই। বাঙালি হিন্দুর ছেলে যদি তাহার প্রতিবেশী মুসলমানের শাস্ত্র ও ইতিহাস এবং মুসলমানের ছেলে তাহার প্রতিবেশী হিন্দু শাস্ত্র ও ইতিহাস অবিকৃতভাবে না জানে তবে সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষার দ্বারা তাহারা কেহই আপন জীবনের কর্তব্য ভালো করিয়া পালন করিতে পারিবে না।” রবীন্দ্রনাথের এই পরিকল্পনা যথার্থ, তবে দুঃখের কথা এই এখনও পর্যন্ত সেই চেষ্টা আমরা করি না। সংখ্যালঘু বাঙালি সংখ্যাগুরুর সমাজ সংস্কৃতিকে চিনলেও সংখ্যাগুরু অনেক সময় নিজের গুরুত্বের অহমিকায় অপরের থেকে দূরে থাকেন। অথচ দুই বাঙালি যদি একই সাহিত্যগ্রন্থে, একই সঙ্গীতে নিস্নাত হন তা হলে অপরিচয়ের অন্তরাল ভাঙার পথ তৈরি হয়। এ যে কেবল কল্পনা নয়, রাজনৈতিক ভাবে সত্য, তার প্রমাণ আছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আগে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কর্মীরা গ্রামীণ পাঠাগার থেকে দুই বাঙালির প্রিয় লেখকদের বইগুলি সরিয়ে ফেলতে থাকে। উদ্দেশ্য, দুই বাঙালিকে কাছে আসতে না দেওয়া, ভাষার পরিবর্তে ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে তোলা। তারা অবশ্য সে দেশে সে কাজে সফল হয়নি। রবীন্দ্রসঙ্গীতই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
রবীন্দ্রসাহিত্য দুই বাঙালি পাঠ করেন, তাঁদের অপরিচয়ের দূরত্ব অতিক্রম করতে সাহায্য করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালি উভয়ের বড় আদরের ধন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের ঊর্ধ্বে বাঙালির সম্মিলিত আত্মপরিচয়ের শিকড়ে জল দান করেছে। এই কাজ একই ভাবে করেছে নজরুলের গান, নজরুলকে হিন্দু বাঙালি যে ভাবে গ্রহণ করেছে সে ভাবে আর কোনও ‘মুসলমান’ লেখককে গ্রহণ করেনি। কী তার কারণ? কারণ একাধিক। নজরুল গ্রামীণ, দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পারিবারিক বাঁধন তাঁর জীবনে খুব দৃঢ় ছিল না। পরিবারের বাইরে বৃহৎ বিশ্বের অভিজ্ঞতা তাঁকে বাস্তববোধ প্রদান করেছিল। অনাত্মীয়দের সঙ্গে সহজ আত্মীয়তা স্থাপন করতে পারতেন— ধর্ম সেই আত্মীয়তা স্থাপনে অন্তরায় হয়নি। আত্মীয়তার মূলে যে নমনীয় সাহচর্য বোধ ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর গভীর ভাবে ক্রিয়াশীল নজরুল তা জানতেন। তাঁর নিজের নাম ‘নাজিরুল’— সহজ বাংলা উচ্চারণে নজরুল করে নিয়েছিলেন। নজর্ শব্দের সঙ্গে উল্ প্রত্যয় যোগ করলে নজর্উল সেখান থেকেই কালান্তরে নাজিরুল ও নজরুল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ইসলামের ভারতীয় রূপ কী ভাবে গড়ে উঠেছিল ও সেই ‘ভারতীয় ইসলাম’-এর গুরুত্ব কী অর্থে অপরিসীম সে বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। নজরুলের জীবন ও কর্ম ইসলামের ভারতীয়করণের আদর্শ উদাহরণ। তিনি তাঁর সাহিত্যে ইসলামি উপাদানের বঙ্গীকরণ অনায়াসে করতে পেরেছিলেন। তাঁর গানে ও কবিতায় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ অনায়াসে প্রবেশ করেছিল। তীব্র আবেগ ও স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর সৃষ্টির মূল। ফলে অনায়াসে সহজাত দক্ষতায় বিভিন্ন শব্দকে পাশাপাশি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেন না। তাঁর সাংস্কৃতিক সম্মিলন আয়াসসাধ্য নয়, অনায়াস। অনায়াস বলেই তিনি সুফি সংস্কৃতি ও শ্যামাসঙ্গীত দুয়েরই স্রষ্টা। অল্প বয়সে লেটো গানের দলে থাকার সময় তিনি ইসলামের সঙ্গে যুক্ত পুরাকাহিনি ও হিন্দু পুরাণের বৃত্তান্ত শেখেন। সেই বাল্যশিক্ষা পরিণত জীবনে কাজে লেগেছিল।
অপরিচয়ের অসময়ে নজরুলের জীবন ও সাহিত্য দুই বাঙালির আদর্শ হতে পারে। প্রশ্ন ও সঙ্কট অবশ্য কেবল বাঙালি জীবনের নয়, সমগ্র ভারতেরই। ভারতের হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে আড়চোখে দেখছেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সেই মনোভাবকে তাদের সুবিধার্থে কাজে লাগাচ্ছে। এক পক্ষ তাদের ধর্মীয় চিহ্নকে বৃহৎ রূপে দৃশ্যমান করলে অন্য পক্ষও তাই করবে। নজরুলের আদর্শ এরই মূর্ত বিরোধিতা। অনায়াস স্বতঃস্ফূর্ততায় তিনি যে সাম্যের গান গাইতে চেয়েছিলেন তাতে সব বাধা ব্যবধান দূর করে মানুষ মানুষের কাছে আসতে চাইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy