পুরুষ পাখি গান গায় স্ত্রী পাখিকে যৌনতায় প্রলুব্ধ করার জন্য।
পাখির গান অনেক কাল বিস্ময়ের বস্তু ছিল। এ ব্যাপারে অনেকের সঙ্গে কৌতূহলী ছিলেন চার্লস রবার্ট ডারউইনও। তাঁর দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান, অ্যান্ড রিলেশন টু সেক্স গ্রন্থে তিনি প্রথম এ বিষয়ে অলোকপাত করেন। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ অন দি ওরিজিন অব স্পিসিস বাই মিনস অব ন্যাচারাল সিলেকশন, অর দ্য প্রিজ়ারভেশন অব ফেভারড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ-এর ১২ বছর পরে ডারউইন ওই বই লেখেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ওই বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কের ঝড় ওঠে। ওই বইতে ডারউইন উন্মোচন করেন পাখির গানের রহস্য। তাঁর মতে, গানের উৎসে যৌনতা। পুরুষ পাখি গান গায় স্ত্রী পাখিকে যৌনতায় প্রলুব্ধ করার জন্য। এ এক নতুন ধারণা, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন থেকে আলাদা। ডারউইন এই ধারণায় জীবজগতে বিবর্তনের সাহায্যকারী দ্বিতীয় উপকরণ হাজির করেন— প্রথম প্রাকৃতিক নির্বাচন, দ্বিতীয় যৌনতা। জীবজগতের বিবর্তনে যৌনতার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন ডারউইন। তিনি বুঝতে পারেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টির জন্য সঙ্গী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ভিন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টি অসম্ভব। ডারউইন লেখেন যে, সঙ্গিনীর সন্ধানে রত থাকার জন্য জীবরাজ্যে পুরুষ প্রজাতি বেশি বলশালী হয়। পুরুষ হরিণের শিং দীর্ঘ এবং প্যাঁচানো হয় নাকি সঙ্গিনী নির্বাচনে যুদ্ধের প্রয়োজনে। ডারউইন লিখেছিলেন, ময়ূর দেখলেই তিনি বিরক্ত হতেন। পুরুষ ময়ূরের পেখম— যা কোনও মতেই বংশগতি রক্ষায় সহায়ক নয়, কারণ বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ময়ূরকে পেখম দ্রুতগতি হতে বাধা দেয়— আজও রয়ে গিয়েছে শুধু সঙ্গিনীকে অভিভূত করার জন্য। পাখিদের গানও তেমনই। পুরুষ পাখি গান গায়, যাতে সেই গান শুনে স্ত্রী পাখি তার সঙ্গী নির্বাচন করতে পারে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন কলোরোডা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপিকা লরিন বেনেডিক্ট এবং গ্যালাকটিক পলিম্যাথ স্টুডিয়োর প্রধান ম্যাট উইলকিন্স এখন লিখেছেন, স্ত্রী পাখিও গান গায়। ২০২০ সালে ওঁরা উত্তর আমেরিকার পাখিদের উপর বড় মাপের গবেষণা করে ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। সিদ্ধান্তটি চমকপ্রদ। কারণ, এতে একটি তত্ত্ব নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে— প্রাকৃতিক নির্বাচনের পাশাপাশি যদি সমান গুরুত্বপূর্ণ না হয় সঙ্গী নির্বাচন, তবে ডারউইনের তত্ত্ব টেকে না। অথবা টেকে এই অর্থে যে, সঙ্গীর যেমন সঙ্গিনী নির্বাচনের দায় আছে, সঙ্গিনীরও তেমনই সঙ্গী নির্বাচনের দায় আছে। পুরুষ পাখি গান গায় এবং তা শুনে স্ত্রী পাখি পছন্দ করে সঙ্গী, এই তত্ত্বের পাল্টা তত্ত্ব এমনও হতে পারে যে, স্ত্রী পাখি গান গায় এবং তা শুনে পুরুষ পাখি পছন্দ করে সঙ্গিনী। যৌনতা, অতএব, গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তনে। শুধু একটি রহস্যের মীমাংসা হয় না এই তত্ত্বে। জীবরাজ্যে পুরুষ প্রজাতি কেন বেশি বলশালী? পুরুষ প্রজাতি কেন দেহগঠনে আলাদা? কেন সেই পৃথকত্ব সঙ্গিনী নির্বাচনে সংঘর্ষের ইঙ্গিত বহন করে? এ কথা ঠিক যে, ময়ূরীর পেখম থাকে না, হরিণীর শিং দীর্ঘ ও প্যাঁচানো হয় না।
ডারউইনের সেক্সুয়াল সিলেকশন তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিলেন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। তিনি বিবর্তন তত্ত্বের যুগ্ম আবিষ্কর্তা, যদিও বিবর্তনের প্রবক্তা হিসেবে ডারউইনের নামই বেশি প্রচলিত। তবে আসল ঘটনা এই যে, ওয়ালেসও ডারউইনের মতোই ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী, বিশ্ব পর্যটনে জীবাশ্ম সংগ্রহ করে বেড়াতেন। এই ওয়ালেস ১৮৫৮ সালে ডারউইনকে এক চিঠি লেখেন মালয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে তাঁর বিবর্তন তত্ত্ব জানিয়ে। ডারউইন জানতে পারেন, তাঁর বিবর্তন তত্ত্ব এবং ওয়ালেসের তত্ত্ব একই। তখন ডারউইনের দুই বন্ধু চার্লস লিয়েল এবং জোসেফ ডালটন লুকার এমন ব্যবস্থা করলেন, যাতে লিনিয়ান সোসাইটির অধিবেশনে এক সঙ্গে পড়া হয় ডারউইনের এবং ওয়ালেসের লেখা পেপার। আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস সেক্সুয়াল সিলেকশন-এর বিরোধিতা করেছিলেন শুধু একটি কারণে— জীবজন্তুর স্ত্রী প্রজাতি যে পছন্দ-অপছন্দের মতো একটা জটিল সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা ওয়ালেসের মনে হয়েছিল অসম্ভব। ও-রকম সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তো তার আগে একটা নান্দনিক বোধ থাকতে হয়। জীবজন্তুর তা আছে কি, থাকা কি আদৌ সম্ভব— এই প্রশ্ন তুলে ওয়ালেস সেক্সুয়াল সিলেকশন-এর বিরোধিতা করেন। অতএব, স্ত্রী পাখি গান গায়, এই মর্মে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণটি বিবর্তন চিন্তার উপরে নতুন আঘাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy