প্রতীকী ছবি।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভারত যখন সমাজতন্ত্রের ভূতকে কুলার বাতাস দিয়া বিদায় করিয়া মুক্ত অর্থনীতির দুনিয়ায় পা ফেলিতেছিল, তখন একটি কথা জনপ্রিয় হইয়াছিল— খিড়কি দিয়া, চুপিসারে, সংস্কার। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, তখন ভারতীয় রাজনীতি ও বৃহত্তর অর্থে সমাজের চেহারাটি এমনই ছিল যে, সংস্কারের ঢাকঢোল পিটাইলে প্রতিরোধের চোটে প্রক্রিয়াটিই আটকাইয়া যাইতে পারিত। পরবর্তী তিন দশকে গঙ্গায় অনেক জল বহিয়া গিয়াছে— দেশের মানুষ বুঝিয়াছেন, আর্থিক সংস্কারের খোলা হাওয়ায় যাহা ভাসিয়া আসে, তাহার নাম কুশলতা, তাহার নাম উৎপাদনশীলতা, তাহার নাম উন্নতি। তিন দশকে ভারতের মন পাল্টাইয়াছে। তাহা হইলে, বিমাক্ষেত্রে সরকারি অংশীদারি ৫১ শতাংশ রাখিবার বাধ্যবাধকতা আর থাকিল না, সংস্কারের এই বার্তাটি লইয়া আজিকার ভারতেও লুকোছাপার দরকার পড়িল কেন? অর্থমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাইতে পারিতেন যে, বিমাসংস্থা চালনা করা সরকারের কাজ নহে। আধুনিক অর্থব্যবস্থাগুলিতে বিমার ব্যবসা বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে থাকে— সরকারের কাজ সেই শিল্পের দিকে নজর রাখা; কোনও অবৈধ পদ্ধতি যাহাতে অনুসৃত না হয়, তাহা নিশ্চিত করা। ভারতেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হইবার কারণ নাই। বস্তুত, বিমাক্ষেত্রটিতে বেসরকারি ও বিদেশি পুঁজিকে প্রবেশাধিকার দেওয়ার বিশেষ কোনও কুফল গত দুই দশকে ভারতের বাজারে লক্ষিত হয় নাই। সুতরাং, সংস্কারের পরের ধাপ হিসাবে সরকার বিমাক্ষেত্র হইতে সরিয়া দাঁড়াইতে চাহিলে তাহা স্বাভাবিক ও ন্যায্য পদক্ষেপ। সেই ন্যায্য কথাটি বলিতে অর্থমন্ত্রীর এত দ্বিধা কেন?
দ্বিধার একাধিক কারণ থাকিতে পারে। হয়তো যে সংস্কারের পথে তাঁহারা হাঁটিতেছেন, সেই পথের উপর তাঁহাদের তেমন বিশ্বাস নাই। ঘটনা হইল, উদার অর্থনীতি বিষয়ে নাগপুরের অবস্থান ইতিবাচক নহে— অন্য ক্ষেত্রগুলির ন্যায় অর্থনীতিতেও নাগপুর অচলায়তনে বিশ্বাসী। ফলে, সন্দেহ হইতে পারে যে, খিড়কিটি প্রয়োজন নাগপুরের নজর এড়াইয়া সংস্কার করিবার জন্যই। তবে, আরও একটি সন্দেহ হইবারও কারণ আছে। সমালোচকদের মতে, বিশেষত অর্থব্যবস্থায় অতিমারি থাবা বসাইবার পরে এই সংস্কার যতগুলি ‘সংস্কারমুখী’ সিদ্ধান্ত লইয়াছে, তাহার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাভবান হইয়াছে— বা, হইবে— কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। ফলে, কাহারও সন্দেহ হইতে পারে যে, বিমাক্ষেত্রে সংস্কারের সিদ্ধান্তের পিছনেও হয়তো তেমন কোনও লাভের আখ্যান রহিয়াছে, এবং সেই কারণেই অর্থমন্ত্রী মুক্তকণ্ঠে এই সংস্কারের কথা ঘোষণা করিতে দ্বিধাগ্রস্ত।
ভারতীয় অর্থব্যবস্থা কেবল আশা করিতে পারে যে, কোনও অঘোষিত বিশেষ উদ্দেশ্যে নহে, এই সংস্কারের অভিমুখ সত্যই অধিকতর কুশল আর্থিক ব্যবস্থা, অধিক উৎপাদনশীল অর্থনীতি নির্মাণের দিকে। যে কোনও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে বিচার করিবার ইহাই একমাত্র মাপকাঠি— দেখিয়া লওয়া যে, পরিবর্তনের ফলে ব্যবস্থাটির উৎপাদনশীলতা বাড়িল কি না। তবে, ভারতে সাধারণ মানুষের নিকট জীবন বিমার একটি ভিন্ন মহিমাও আছে— এখনও অবধি দেশের একটি বড় অংশের মানুষের নিকট এই বিমাই সঞ্চয়ের মুখ্য ক্ষেত্র। ফলে, বহু সাধারণ, আর্থিক ভাবে ক্ষীণবল মানুষের স্বার্থ এই ক্ষেত্রটিতে জড়াইয়া আছে। সংস্কারের সিদ্ধান্ত স্বাগত, কিন্তু দেখিতে হইবে, কোনও ভাবেই যেন এই মানুষগুলির স্বার্থহানি না ঘটে। বস্তুত, বাজারব্যবস্থায় তাহা নিশ্চিত করাই সরকারের কাজ— বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা নহে। আজ যে সংস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত, আগামী কাল তাহার মালিকানা বেসরকারি হাতে গেলেও যাহাতে গ্রাহকদের উপর কোনও আঁচ না পড়ে, তাহা নিশ্চিত করা সংস্কার প্রক্রিয়ারই অঙ্গ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy