পরিসংখ্যানের প্রতি বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদের শ্রদ্ধা আছে, এমন অভিযোগ গত এক দশকে কেউ করেনি। ভবিষ্যতেও যাতে এমন কথা না ওঠে, সম্ভবত তা নিশ্চিত করতেই এই জুলাই থেকে জিএসটি সংগ্রহ সংক্রান্ত মাসিক তথ্য প্রকাশ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল কেন্দ্রীয় সরকার। কেন, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। এমনকি, অজুহাত খাড়া করার চেষ্টাও নেই। কেউ বলতে পারেন, বিজেপির আসনসংখ্যা কুড়ি শতাংশ হ্রাস পেলেও তার দাপট যে তিলমাত্র কমেনি, তা প্রমাণ করার বিবিধ পদক্ষেপের মধ্যে এটিও একটি। রাজনীতির হাড়িকাঠে অর্থনীতিকে বলি চড়ানো হয়েই থাকে, ফলে বিস্ময়ের কারণ নেই। এই তথ্যটি প্রকাশিত না হলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার নাড়ির গতি বোঝা আরও কঠিন হবে। কেন, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত তিন বছরের প্রতি বছরই ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার যথেষ্ট ভাল— আট শতাংশের আশেপাশে। কিন্তু, ২০২৩-২৪’এ শেষ হওয়া পাঁচ বছরে ভারতে জিডিপির প্রকৃত বৃদ্ধি ৩৪ লক্ষ কোটি টাকা; তার আগের পাঁচ বছরে এই বৃদ্ধি ছিল ৪২ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বার্ষিক বৃদ্ধির অঙ্ক প্রকৃত ছবিটিকে ধরতে পারছে না। তার কারণটিও অর্থনীতিবিদদের জানা— লো বেস এফেক্ট, অর্থাৎ আগের বছরের আয় কম হওয়ায় পরবর্তী বছরে প্রকৃত বৃদ্ধির পরিমাণ তুলনায় কম হলেও বৃদ্ধির হারটি ভাল হয়। কোভিড-পরবর্তী সময়ে অর্থব্যবস্থার বেশির ভাগ সূচকেই এই লো বেস এফেক্ট থাকছে। জিএসটি পরিসংখ্যান এই ব্যাধি থেকে মুক্ত ছিল। প্রতি মাসে প্রকাশিত এই পরিসংখ্যান সরাসরি ব্যবহার করা যেত অর্থব্যবস্থার চড়াই-উতরাই বোঝার কাজে।
জিএসটি ভোগব্যয়ের উপর আদায় হওয়া পরোক্ষ কর। ফলে, তার বৃদ্ধির হার দেখে অর্থব্যবস্থায় ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির গতি সরাসরি আঁচ করা যায়। অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের সূচক হিসাবে ভোগব্যয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তার প্রধান কারণ এই যে, ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির গতি দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সরাসরি আন্দাজ দেয়। দ্বিতীয়ত, জিএসটি পরিসংখ্যান যে-হেতু রাজ্যস্তরেও পাওয়া যেত, ফলে তা থেকে রাজ্যগুলির তুলনামূলক অবস্থানও বোঝা যেত। কোন রাজ্য পিছিয়ে পড়ছে, তা বোঝা গেলে পিছিয়ে পড়ার কারণগুলিও চিহ্নিত করা তুলনায় সহজ, তার সমাধানের চেষ্টা করাও। তৃতীয়ত, জিএসটি সংগ্রহের হার দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনুপাত সংগঠিত ক্ষেত্রের বৃদ্ধিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সবচেয়ে বড় কথা, অর্থব্যবস্থার বেশির ভাগ সূচকের পরিসংখ্যানই হাতে আসে খানিক বিলম্বের পর। যেমন, মে মাসের শিল্প উৎপাদন সংক্রান্ত পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে জুলাইয়ে; অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের (এপ্রিল-জুন) জন্য জিডিপির পরিসংখ্যান মিলবে অগস্টে। জিএসটি পরিসংখ্যান সে তুলনায় অনেক দ্রুত পাওয়া যেত। তাতে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা অর্থশাস্ত্রীদের যেমন সুবিধা, তেমনই কোনও বিপদের আঁচও মিলত দ্রুত। এই পরিসংখ্যান প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তটির পিছনে কোনও গূঢ়তর কারণ রয়েছে কি না, সে সংশয় থাকা স্বাভাবিক।
পরিসংখ্যান নিয়ে ছেলেখেলার সবচেয়ে বড় উদাহরণটি হল ২০২১ সালের জনশুমারির কাজ এখনও শুরু না-করা। কোভিডের কারণে শুমারির কাজটি বন্ধ রাখার যে যুক্তি ছিল, গত আড়াই বছরে তা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। এই সময়কালে একাধিক বড় নমুনা-সমীক্ষাও হয়েছে— গৃহস্থালির ভোগব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষাটি যার মধ্যে অন্যতম। ফলে, জনশুমারির কাজ এখনও শুরু করা গেল না কেন, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নেই, থাকতে পারে না। অথবা, আছে। পরিসংখ্যানের যাবতীয় গুরুত্ব নষ্ট করে ক্ষমতাসীন দল আসলে তার রাজনৈতিক পেশিশক্তির প্রমাণ দিতে চায়। এই কু-অভ্যাস ত্যাগ করে সরকার পরিসংখ্যানকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিক। জিএসটির তথ্য প্রকাশ অব্যাহত রাখুক, জনশুমারির কাজটিও শুরু করুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy