অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট-বক্তৃতার একেবারে গোড়াতেই উল্লেখ করলেন কৃষিক্ষেত্রের কথা। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রথম ইঞ্জিন হিসাবে চিহ্নিত করলেন কৃষিকে। নির্মলা নিশ্চয়ই জানেন, ইঞ্জিন যতই শক্তিশালী হোক, তাকে চালাতে হলে পেট্রল-ডিজ়েল ঢালতে হয়। এই বাজেটে কৃষির জন্য মোট বরাদ্দ হল ১.৪৯ লক্ষ কোটি টাকা। গত বছরের বাজেট বরাদ্দের চেয়ে টাকার অঙ্কে মাত্র চার শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতির হার যদি বছরে পাঁচ শতাংশ হয়, তা হলে কৃষিতে প্রকৃত বরাদ্দ কমল এক শতাংশ-বিন্দু। এটুকু জ্বালানিতে ইঞ্জিনটি অর্থমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশার বিপুল বোঝা টানতে পারবে কি না, অর্থমন্ত্রীর বাজেট-ভাষণে স্বভাবতই সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে, কৃষিক্ষেত্র বিষয়ে এই বাজেটে এমন কিছু কথা আছে, যার মধ্যে ভবিষ্যৎ-মুখী ভাবনার লক্ষণ স্পষ্ট। যেমন, কৃষিক্ষেত্রে অনুন্নত, দেশের এমন ১০০টি জেলা বেছে নিয়ে সেখানে প্রধানমন্ত্রী ধনধান্য কৃষি যোজনা আরম্ভ করার কথা বলা হয়েছে। জেলা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মাপকাঠিগুলি হল, সেখানে কৃষির উৎপাদনশীলতা কম, এলাকায় মোট জমির যত শতাংশ কৃষির অন্তর্ভুক্ত, তার পরিমাণ মাঝারি, এবং কৃষিক্ষেত্রে ঋণের জোগানও দেশের গড় হারের চেয়ে কম। অর্থমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, এই জেলাগুলিতে ধনধান্য কৃষি প্রকল্পের অধীনে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হবে, সুস্থায়ী কৃষির প্রচলন করা হবে, ফসলের বৈচিত্রায়ন হবে, উৎপাদিত ফসল পঞ্চায়েত ও ব্লক স্তরে মজুত রাখার ব্যবস্থাকে জোরদার করা হবে, সেচের পরিমাণ বাড়ানো হবে, এবং ঋণের লভ্যতা বৃদ্ধি করা হবে। কৃষির উন্নতির জন্য এই ব্যবস্থাগুলির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব এত দিনে স্পষ্ট। বাজেট-ভাষণে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, মোট ৩২টি ফসলের ১০৯ গোত্রের উচ্চ উৎপাদনশীল ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সইতে সক্ষম বিকল্পের দিকে জোর দেবে সরকার। অন্য দিকে, ভারতীয় কৃষির একটি মস্ত সমস্যা, মজুত রাখার ব্যবস্থার অভাবের ফলে ফসল নষ্ট হওয়া। প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত আনাজ ও ফলমূলের যথাক্রমে ৭.৩ শতাংশ ও ৮.১ শতাংশ যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়। এমনিতেই কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তার উপরে এই অপচয়ের ফলে বাজারে আনাজ ও ফলমূলের জোগানে আরও টান পড়ে। এই ক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নি বাড়ানোর দিকে সরকার জোর দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সরকারের তরফে যথেষ্ট উদ্যোগ না থাকলে যে বেসরকারি পুঁজি যথেষ্ট লগ্নি করতে ইচ্ছুক হয় না, তার প্রমাণও মিলেছে। এই বাজেটে এ দিকে আরও নজর দেওয়ার অবকাশ অর্থমন্ত্রীর ছিল।
আসল কথাটি হল, বাজেট-ভাষণে যে সদিচ্ছার প্রমাণ অর্থমন্ত্রী দিতে চেয়েছেন, তাকে ধারণ করতে পারার মতো অর্থবরাদ্দ কৃষিতে হয়নি। কৃষিক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ যদি গত বাজেটের চেয়ে এই বাজেটে কমে, তা হলে কাঠামোগত উন্নতির কাজটি যে অধরাই থেকে যাবে, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।যেমন, জলবায়ু পরিবর্তন সহ্য করার মতো কৃষির পথে হাঁটার কথা রয়েছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কৃষি গবেষণায় বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে তিলমাত্র। আন্তর্জাতিক স্তরে কৃষি-জিডিপির যে অনুপাত গবেষণার খাতে ব্যয় করা হয়ে থাকে, ভারতে এই ক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ তার অর্ধেক মাত্র। ফল ও আনাজের উৎপাদন বৃদ্ধি ও তার সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। এতে কাজের কাজ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমনকি, যে ধনধান্য কৃষি যোজনার মধ্যে ইতিবাচক ইঙ্গিতগুলি স্পষ্ট, তার সম্ভাবনাও অর্থাভাবে বিনষ্ট হতে পারে। উদাহরণ আরও বাড়ানো যায়, কিন্তু তার প্রয়োজন নেই— আসল কথাটি অপরিবর্তিতই থাকবে। ইঞ্জিনের ক্ষমতা যা-ই হোক না কেন, সরকার যদি তাতে জ্বালানির জোগান না দিতে পারে, তবে অর্থব্যবস্থার গাড়ি গতিশীল হবে কী ভাবে?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)