সব কথার আগে যা বলা দরকার তা হল: তিনি চেষ্টা করেছিলেন। দীর্ঘকালের অচলাবস্থা থেকে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিকে উন্নয়নের মানচিত্রে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। সহস্রাব্দের সূচনায় মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে জ্যোতি বসুর উত্তরসূরি দ্রুত উপলব্ধি করেন যে এই রাজ্যের প্রথম এবং প্রধান সমস্যা বড় বিনিয়োগের অভাব। এবং তিনি জানতেন অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেনস-এর কালজয়ী কথাটি: বিনিয়োগ আস্থার ব্যাপার। দশকের পর দশক ধরে এই রাজ্য সম্পর্কে দেশের ও বিদেশের বিনিয়োগকারীরা উত্তরোত্তর আস্থা হারিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহকারে জয়ী হওয়ার পরে মহাকরণে ফিরে বুদ্ধদেববাবু সেই আস্থা ফেরাতে তৎপর হন। তৎপরতা সে-দিন নিষ্ফল হয়নি। পরবর্তী কয়েক বছরের ইতিহাসের পাতা ওল্টালে তাঁর অতি বড় বিরোধীও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ঘরে-বাইরে তখন পশ্চিমবঙ্গ এবং তার রাজধানী শহরটির পুনরুজ্জীবন নিয়ে বিস্তর কলরব উঠেছিল, তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আঁকা হয়েছিল বহু উজ্জ্বল ছবি। ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ শব্দবন্ধটি পরে যে ব্যঞ্জনাই পরিগ্রহ করুক না কেন, সেই সংক্ষিপ্ত পর্বটিতে তা ছিল রাজ্যের ঘুরে দাঁড়ানোর এক সম্ভাবনাময় প্রকরণ। সিঙ্গুরে টাটা মোটরস-এর প্রস্তাবিত শিল্পপ্রকল্পটি ছিল তার এক নম্বর প্রতীক, যে প্রকল্পের বিপর্যয় কার্যত চোখের পলকে সাড়ে তিন দশকের বামফ্রন্ট সরকার এবং তার দ্বিতীয় ও শেষ মুখ্যমন্ত্রীকে অতীত করে দেয়।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সেই অতীত এক অর্থে সম্পূর্ণ হল। শারীরিক অসুস্থতা এবং সম্ভবত মানসিক বিষাদ অনেক দিন আগেই তাঁকে রাজনৈতিক জীবন তথা জনপরিসর থেকে দূরে রেখেছিল। কিছুটা সঙ্গত কারণে, কিছুটা বঙ্গসমাজ এবং সেই সমাজের মানসিকতায় আশ্রিত দলীয় সহকর্মী ও অনুগামীদের অনীহার ফলে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের যথার্থ পর্যালোচনা ও নির্মোহ বিশ্লেষণের কোনও চেষ্টা কার্যত শুরুই হয়নি। তিনি চলে যাওয়ার পরেও তা হবে কি না, বলা শক্ত। দলের ভাবনা দল ভাববে। কিন্তু সমাজের পক্ষে সেই ভাবনা আজও অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিজীবন চর্চার কারণে নয়, সমাজের নিজের স্বার্থে জরুরি। ক্ষতবিক্ষত হতশ্রী অন্ধকারাচ্ছন্ন এই রাজ্যটিকে যদি উঠে এবং ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগ এবং তার ব্যর্থ পরিণতি সেই শিক্ষণীয় ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
অনেকে বলবেন, বুদ্ধদেববাবুর বিচক্ষণতার অভাব এবং তাঁর অভিমান তথা অহমিকাই তাঁর ব্যর্থতার কারণ। কেবল সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে নয়, পুলিশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অন্য বিষয়েও তাঁর অসহিষ্ণু আত্মগরিমা সরকারের পক্ষে এবং নিজের পক্ষেও আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। যথার্থ জনসংযোগের অভাব সেই সমস্যাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল। তাঁর প্রশাসন যদি বুঝতে পারত বিভিন্ন অঞ্চলে এবং প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় দলপতিদের দাপট সমাজের এক বিরাট অংশে কী পরিমাণ ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে, সম্ভবত এত অবিশ্বাস্য দ্রুততায় দলের পতন ঘটত না। সেই পতনের পিছনে তাঁর দলের দায় যে বিপুল, তা তিনি নিজে বুঝেছিলেন। শুধু দলতন্ত্রের দুরাচার নয়, শুধু বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মজ্জাগত অগণতান্ত্রিকতা নয়, শিল্পসংস্কৃতিতে তাঁর যে অনায়াস অধিকার, শিল্প-প্রতিষ্ঠা বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেতৃত্বে তার ধারেকাছেও নয়। দলের কোনও স্তরেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উন্নয়ন-চিন্তা সাড়া জাগাতে পারেনি, তিনি শেষ অবধি কার্যত নিঃসঙ্গ থেকে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় আক্ষেপের কথা এই যে, পশ্চিমবঙ্গের সমাজেও উন্নয়নের অনুকূল মানসিকতা ছিল অত্যন্ত দুর্বল, ফলে তাঁর সৎ উদ্দেশ্য সেই সমাজের কাছে কানাকড়ি মূল্যও পায়নি। সমাজের মন আজও সেই তিমিরেই। সেই কারণেই সব কথার শেষে যা বলা দরকার তা হল: তিনি চেষ্টা করেছিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy