Advertisement
১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Brain Rot

মগজাস্ত্র

যদি এমন হয় যে মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করার আর কোনও দরকারই থাকল না, সে নিজেই অসাড়, নিষ্ক্রিয়, অচল হয়ে পড়ল? অসার কল্পনা নয়, কঠোর বাস্তব।

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৪:২৭
Share: Save:

গত শতাব্দীর শেষ দশকে কলকাতার নাগরিক কবিয়াল ঘোষণা করেছিলেন: ‘মগজে কারফিউ’ জারি হয়েছে, নিজের মতো করে ভাবতে গেলে ‘পেয়াদা ধরবে, বেঘোরে মরবে’। স্বাধীন মগজের অবাধ গতিবিধিকে ক্ষমতাবানেরা সর্বত্র এবং সর্বদা ভয় পায়, নানা ভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে, নিষ্ক্রিয় করতে তৎপর হয়ে ওঠে। মুসোলিনির ইটালিতে আন্তোনিয়ো গ্রামশির ‘বিচার’ চলার সময় সরকারি উকিল জানান: এই মগজটিকে কুড়ি বছর কাজ করতে দেওয়া যাবে না। হীরক রাজ্যের অধিপতি তাঁর শিক্ষামন্ত্রীকে অমৃতবচন শুনিয়ে দেন: ওরা যত বেশি পড়ে, তত কম জানে, তত কম মানে, অতএব আজ থেকে পাঠশালা বন্ধ। এবং মগজের পুষ্টি রোধ করেই সন্তুষ্ট হন না তিনি, তৈরি হয় মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র। শতাব্দী পাল্টেছে, ক্ষমতার স্বভাব দুর্মর। দুনিয়ার বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে সজাগ এবং সজীব মগজের ভয়ে সদা-সন্ত্রস্ত নেতানেত্রীরা ক্রমাগত চতুর্দিকে রকমারি জুজু দেখতে থাকেন, কখনও তার নাম আর্বান নকশাল, কখনও মাওবাদী। রাষ্ট্রশক্তির অচলায়তন থেকে ক্রমাগত প্রবল স্বরে ঘোষিত হতে থাকে রক্তচক্ষু নিষেধাজ্ঞা: মগজে কারফিউ।

কিন্তু যদি এমন হয় যে মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করার আর কোনও দরকারই থাকল না, সে নিজেই অসাড়, নিষ্ক্রিয়, অচল হয়ে পড়ল? অসার কল্পনা নয়, কঠোর বাস্তব। এই বাস্তবের এক অসামান্য রূপ উন্মোচিত হয়েছে একটি ইংরেজি শব্দের দর্পণে। প্রতি বছরের মতো এ-বারেও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস একটি শব্দকে বেছে নিয়েছে ২০২৪ সালের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য শব্দ হিসাবে। এমন যে কোনও নির্বাচন নিয়েই দ্বিমত থাকে, থাকতে বাধ্য। কিন্তু প্রথমত, ইংরেজি ভাষার ভুবনে অক্সফোর্ড অভিধানের প্রকাশকের একটি বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা আজও বহাল। দ্বিতীয়ত, বছরের ‘সেরা’ শব্দ নির্বাচনের জন্য অক্সফোর্ড বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে থাকে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বহু শব্দের তালিকা থেকে এক দীর্ঘ, শ্রমসাধ্য ও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কয়েকটি স্তরে ভেঙে ভেঙে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছয়। সেই প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকেরও একটি বড় ভূমিকা থাকে, এ-বারেও যেমন সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় চল্লিশ হাজার নাগরিকের মতামত। এবং শেষ অবধি অন্য প্রতিযোগীদের পরাজিত করে এই কঠিন পরীক্ষায় যে শব্দবন্ধটি জয়ী হয়েছে সেটি হল ‘ব্রেন রট’। বাংলা করলে দাঁড়ায় মস্তিষ্কের পচন। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বহু মানুষ একটি সমকালীন সামাজিক প্রবণতাকে বোঝাতে গত এক বছরে এই শব্দটি বহু বার ব্যবহার করেছেন। কী সেই প্রবণতা? ক্রমাগত হরেক রকমের অগভীর ও অবান্তর তথ্য আর কথা দেখে, শুনে এবং পড়ে মানুষের মগজ অসাড় হয়ে যাচ্ছে, মানুষ কোনও বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে ভুলে যাচ্ছে। এক কথায়, লোকের মগজ পচে গিয়েছে।

কোথা থেকে আসে অগভীর এবং অবান্তর কথা আর তথ্যের এমন বিপুল স্রোত? বলা বাহুল্য, তার প্রধান উৎস হল সমাজমাধ্যম। বার্ষিক শব্দ-সমীক্ষাতেও সেই সত্যই উদ্ঘাটিত। সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন পরিসরে প্রতিনিয়ত অগণিত নাগরিকের বিরামহীন কথা ও ছবি ভেসে আসে, তাঁরা সেই স্রোতে নিরন্তর ভেসে চলেন। এই অবিরাম মহাপ্লাবনে এক মুহূর্তও থামার অবকাশ নেই, কোনও বিষয়ে সময় নিয়ে মনোনিবেশের ফুরসত নেই। মানুষের মস্তিষ্ক এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে নিজের স্বাভাবিক জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলছে। মনে রাখতে হবে, সেই শক্তি একমাত্র সচেতন ভাবনার মধ্য দিয়েই নিজেকে পুষ্টি দিতে পারে, ভাবনার সুযোগ হারিয়ে গেলে মগজ নিজেই ঝাঁপ ফেলে দেয়, তখন আর বাইরে থেকে কারফিউ জারি করার কোনও দরকার হয় না। শব্দবিশেষজ্ঞরা এই প্রক্রিয়াটিকে নির্ভুল ভাবে চিহ্নিত করেছেন। তার পিছনে অর্থনীতি ও রাজনীতির যে গভীর লীলা কাজ করছে সে বিষয়ে অবশ্য তাঁরা— বিশেষজ্ঞ হিসাবে— কিছু বলেননি। বলার কথাও নয়। সেই কাজ সমাজবিজ্ঞানীদের, এবং প্রতিটি সচেতন নাগরিকের। এক দিকে অর্থনীতির অধীশ্বররা চাইছেন নিশ্চেতন উপভোক্তা তৈরি করতে, অন্য দিকে রাজনীতির নিয়ামকরা চাইছেন প্রশ্নহীন প্রজা উৎপাদন করতে। মস্তিষ্কে পচন ধরলে, চিন্তাশক্তি অসাড় হয়ে গেলে উভয়ের লক্ষ্যই পূর্ণ হয়। ভরসা এইটুকুই যে, দুনিয়া জুড়ে ‘ব্রেন রট’ শব্দটি সারা বছরে যাঁরা ব্যবহার করেছেন, তাঁদের এক বিরাট অংশ বয়সে তরুণ। তাঁদের একটি অংশ যদি এখনও মস্তিষ্কের সচলতা রক্ষার জন্য মগজাস্ত্রে শাণ দেন, তবে অসার অবান্তর কথাসরিৎসাগর থেকে উদ্ধারের পথও মিলবে।

অন্য বিষয়গুলি:

English Oxford Dictionary Oxford University Memory Loss Human Brain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy