মধ্য এপ্রিলে একটি নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিল নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ-এ। ক্যালিফর্নিয়ার এক স্টার্ট-আপ সংস্থা ‘কয়েনবেস’ শেয়ার বাজারের খাতায় নাম লিখাইল, এবং তাহার আইপিও বাজারে পড়ামাত্র জটায়ুর উপন্যাসের ন্যায় বিক্রয় হইয়া গেল। স্মরণকালের মধ্যে এমন তুঙ্গ সফল আইপিও বাজারে আনিয়াছে ফেসবুক ও এয়ারবিএনবি। এই দুইটি সংস্থার সহিত কয়েনবেস-এর একটি মিল আছে— ইদানীংকালের পরিভাষায় যাহাকে বলা হয় ‘ডিসরাপশন’, তিনটি সংস্থার ব্যবসাই চরিত্রে সেই রকম। অর্থাৎ, বাজার যে পথকে কখনও প্রত্যক্ষ করে নাই, সেই পথে হাঁটিয়া বাজারের চরিত্রটি সম্পূর্ণ বদলাইয়া দেওয়া। বিপ্লব-এর নিরিখে ‘কয়েনবেস’ আরও এক ধাপ আগাইয়া আছে, কারণ তাহার ব্যবসা যাহা লইয়া, সেই বস্তুটিই বৈপ্লবিক— ক্রিপ্টোকারেন্সি। এমন ডিজিটাল মুদ্রা, যাহার কোনও ভৌগোলিক সীমানা নাই, যাহার উপর কোনও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নাই। অর্থব্যবস্থা বস্তুটিকে রাষ্ট্রের অধিকারসীমার বাহিরে লইয়া আসাই এই ডিজিটাল মুদ্রার এক মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল। প্রশ্ন উঠিয়াছে, ক্রিপ্টোকারেন্সি সাম্প্রতিক অতীতেই যত বার বিভিন্ন বিতর্কে জড়াইয়াছে— কখনও ড্রাগ ও অস্ত্রের কৃষ্ণ-বাজারের মুদ্রা হিসাবে, কখনও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে, তাহার পরও কি এই মুদ্রার বৈষয়িক ভবিষ্যৎ থাকিতে পারে? দীর্ঘমেয়াদের কথা বলিতে পারে, সাধ্য কাহার— কিন্তু, স্বল্পমেয়াদে এই মুদ্রার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বাজার নিজের আস্থা জানাইয়া দিয়াছে। এই মুদ্রার অন্তর্নিহিত বিপদের কথা অস্বীকার করিয়া নহে, সে বিপদ সত্ত্বেও।
তবুও প্রশ্ন থাকে— এই মুদ্রার নৈতিকতা বিষয়ক প্রশ্ন। যে অর্থব্যবস্থায় কোনও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নাই, চরিত্রগত ভাবেই তাহা নৈরাজ্যপন্থী। সুস্থ বিশ্বব্যবস্থার সহিত সেই নৈরাজ্যের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক কি না, এই তর্কটি অতি জরুরি। এই মুদ্রার সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক দিক হইল, তাহার সম্বন্ধে স্পষ্ট তথ্যের কাঠামোগত অভাব। ফলে, অনিশ্চয়তা তাহার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অন্য দিকে, এই মুদ্রাটি সম্পূর্ণ কম্পিউটার-নির্ভর, এবং আবিশ্ব তাহার চলাচল হওয়ায় প্রবল ভাবে ‘সার্ভার’-নির্ভরও বটে। এই মুদ্রাব্যবস্থা সচল রাখিতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন। পরিবেশের উপর তাহার প্রভাবও মারাত্মক। এই মুদ্রা লইয়া নৈতিকতার প্রশ্নটি বহুস্তরীয়।
নাম নথিভুক্ত হওয়া ইস্তক কয়েনবেস-এর শেয়ার যে গতিতে দৌড়াইয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট যে, ক্রিপ্টোকারেন্সির সহিত জড়িত নৈতিকতার প্রশ্ন লইয়া বাজার ভাবিত নহে। কথাটি শুধু কয়েনবেস নামক সংস্থা, বা ক্রিপ্টোকারেন্সি নামক সম্পদ সম্পর্কে প্রযোজ্য নহে— সর্ব ক্ষেত্রেই বাজারের ধর্ম হইল মুনাফা অর্জন করা। নৈতিকতার বিচার করা বাজারের কাজ নহে। ক্রিপ্টোকারেন্সি যদি তাহার লাভযোগ্যতা হারায়, তবে এই সম্পদকে ছুড়িয়া ফেলিতেও বাজারের সময় লাগিবে না— শতাব্দীর শুরুতে ‘ডট কম বাব্ল’-এর ঘটনাক্রম স্মর্তব্য। সুতরাং, এখানেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যে পণ্যের নৈতিকতা লইয়া প্রশ্ন রহিয়াছে, তাহাকে কী ভাবে ব্যবহার করিতে পারিলে সমাজের সর্বাধিক মঙ্গল, রাষ্ট্রকেই ঠিক করিতে হইবে। তাহাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়া কৃষ্ণ-বাজারের দিকে ঠেলিবে, না কি তাহার বাণিজ্যকে এমনই মূলধারায় আনিয়া ফেলিবে যে, পণ্যটি ক্রমে সমাজের অনুসারী হইয়া উঠে— সেই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রকেই করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy