E-Paper

মধুরেণ সমাপয়েৎ

সব থেকে শব, এই সমগ্র জীবনরেখা জুড়ে সর্বজনমান্য মিষ্টান্নের জিত! কেদারনাথের নকুলদানা থেকে কালীঘাটের পেঁড়া, পুরীর খাজা, শবরীমালার আপ্পাম, তিরুপতির লাড্ডু অবধি দেবদেবীদের প্রসাদ সব সময়েই মিষ্টরসে সিক্ত।

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:৪২
Share
Save

মহিষাসুর বধ শেষ হওয়ার পর মৃন্ময়ী মেয়ের ঠোঁটে মিষ্টি গুঁজে, পানপাতা দিয়ে সযত্নে তার গর্জনতেললাঞ্ছিত দুই গাল মুছিয়ে তাঁকে ফের স্বামীর ঘরে পাঠানোর কথা। আজকের এই দশমী থেকেই মধুমেহাসুর ও বহুমূত্রাসুরের আশঙ্কা থেকে বাঙালির সাময়িক মুক্তি। বাঙালি যতই পেটরোগা হোক, স্থূলত্ব, ডায়াবিটিস ইত্যাদি যতই বাড়ুক না কেন, বিজয়ার পর বাড়িতে কেউ প্রণাম ঠুকতে বা কোলাকুলি সারতে এলে তথাকথিত স্বাস্থ্যসম্মত রীতি-রেওয়াজকে পাত্তা না দিয়ে মিষ্টি খাওয়াতে হবে— এই প্রথা আজও অটুট। গত কয়েক রাত উৎসবে কাটিয়ে থাকুন বা প্রতিবাদে, রীতির রকমফের ঘটবে না। মিষ্টি খাওয়া ও খাওয়ানোর নিয়ম উভয় ক্ষেত্রেই পরিব্যাপ্ত। যে সব বহুতল ও ক্লাব পঁচাশি-হাজারি অনুদান নিয়েছে বা নেয়নি, তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে না। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর শূন্যতায় জর্জরিত হয়ে ‘আসছে বছর আবার হবে’ স্লোগানে ভর করে ম্যাটাডোর বা লরির ডালা থেকে নেমে এলে তাঁদের অন্তত একটি রসগোল্লা দাঁতে কাটতে দিতে হবে। এ-ই বাঙালির ঐতিহ্য।

জনতার স্লোগানে স্লোগানে এ বারের উৎসব যখন প্রথম থেকেই বিতর্কিত হয়ে উঠল, লোকপ্রথাটি এক বার খুঁটিয়ে দেখা যেতেই পারে। কোনও প্রিয়জনকে চিরতরে বিসর্জন দিয়ে ফেরার পর শ্মশানযাত্রীকে একটি থালায় লোহার সাঁড়াশি, মোমবাতি বা প্রদীপের আগুন ছুঁয়ে, তুলসীপাতা স্পর্শ করে দাঁতে মিষ্টি কেটে ঘরে ঢুকতে হয়। যে মৃন্ময়ী কন্যাকে কয়েক সপ্তাহ আগে আগমনী গেয়ে সংসারে নিয়ে এসেছি, তাঁকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আবার ভোলেভালা, অপদার্থ, গাঁজাখোর স্বামীর ঘরে পাঠাতে হল। চিরতরে না হলেও এক বছরের জন্য বিসর্জন তো বটে! অতএব বার্ষিক দেবীবিদায়ের এই ক্ষণে, বিসর্জন দিয়ে ফিরে আসার পর লোহা আর তুলসীপাতা থাকল না, রয়ে গেল মিষ্টি। ক্ষমতা যা-ই বলুক না কেন, আমজনতা যখন বর্ণমালায় দন্ত্য স খচিত ‘সব’ থেকে তালব্য শ-খচিত ‘শব’-এর মধ্যে দূরত্ব ঘোচানোর ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধে নামে, তখন তার যেন একটা বৃহত্তর অর্থ রচিত হয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ জানাচ্ছেন, মৃতদেহ পচনশীল। যা পচে, তাকে ‘শব’ বলে। আর ‘সব’ বা সকল বহুবচন, সংখ্যাবাচক। ‘উৎ’ নামক উপসর্গটি অটুট থাকলেও এই সংসারে সবই এক দিন শবে রূপান্তরিত হবে, কে না জানে! শব হিসাবেই দেবী প্রথম প্রকটিত হন। বাঙালির শেষ মঙ্গলকাব্য, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল সেখান থেকেই শুরু। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব তিন জনে নদীর ধারে ধ্যানে বসেছেন; জগজ্জননী মহামায়া তাঁদের পরীক্ষা করতে চাইলেন, গলিত শবরূপে ভাসতে ভাসতে পৌঁছলেন তিনি। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু ধ্যান ভেঙে উঠে গেলেন। কিন্তু শিব জ্ঞানী, দুর্গন্ধে ঘৃণা নেই। তিনি সেই শব ধরেও ধ্যানে নিমগ্ন রইলেন, মহামায়া এ বার তাঁর কোলে উঠে বসলেন। তাতেও বিকার হল না। অতঃপর শিব ও মহামায়ার মিলনে মানুষ ও অন্য সব প্রজাদের সৃষ্টি। শব থেকেই সব হবে, বাঙালি জানে।

সব থেকে শব, এই সমগ্র জীবনরেখা জুড়ে সর্বজনমান্য মিষ্টান্নের জিত! কেদারনাথের নকুলদানা থেকে কালীঘাটের পেঁড়া, পুরীর খাজা, শবরীমালার আপ্পাম, তিরুপতির লাড্ডু অবধি দেবদেবীদের প্রসাদ সব সময়েই মিষ্টরসে সিক্ত। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় দশমীতে ঠাকুরবরণ করতে এসে যে ভাবে দেবীর পায়ে আলতা ও ঠোঁটে দোকানের সন্দেশ ছুঁইয়ে যান, তাকে সর্বজনমান্য প্রসাদ বলা না গেলেও সেখানেই বাঙালিয়ানার বৈশিষ্ট্য। তিরুপতির লাড্ডুতে চর্বি মেশানো হয়েছে কি না, তা নিয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট অবধি হরেক তর্কবিতর্ক চলল। অথচ মন্দিরের মেশিনে তৈরি লাড্ডু নয়, জনতা তার সামর্থ্যমাফিক দেবী থেকে সিংহ, অসুর সকলের মুখে এ দিন সন্দেশ বা নারকেলের তক্তি ছুঁইয়ে প্রণাম করে আসবে, সেই উলটপুরাণেই বাঙালির জয়। ল্যাপটপশোভিত, স্মার্টফোনধৃত বাঙালি আজকাল আর বিসর্জনের পর ঘরের দেওয়ালে অন্দরসজ্জা নষ্টের ভয়ে মায়ের রাংতাখচিত খাঁড়া বা চাঁদমালা রাখতে চায় না, লাল কালিতে ‘শ্রীশ্রীদুর্গাসহায়’ বলে দুর্গার নাম লেখার প্রথাও বিলুপ্ত, শুধু সন্দেশ, রসগোল্লা, ল্যাংচা ও মন্ডা-মিঠাই খাওয়ানোর প্রথাটি অটুট। পর্তুগিজ়রা দুধ কেটে ছানা তৈরির কারিকুরি না জানালে বিজয়া দশমীতেও আমরা রসগোল্লা, সন্দেশ, ল্যাংচা জানতে পারতাম না। ক্ষীর, মতিচুর, ঘিয়ে ভাজা বেসনের লাড্ডুতেই আটকে থাকতে হত। সৌভাগ্য বলতে হবে, ‘কাটা দুধের ছানায় নয়, ক্ষীরের মিষ্টিতে ফিরুন’ বলে কোনও নিদান এখনও আসেনি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sweets Bengalis Bengali Tradition Bengali Culture Health care

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।