মুখ্যমন্ত্রীর পদটি ত্যাগ করলেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল— জানালেন, মানুষের রায়ে ক্ষমতায় ফিরে তবেই ফের মুখ্যমন্ত্রী হবেন তিনি। ভারতীয় রাজনীতিতে এ এক বিরল ঘটনা, সন্দেহ নেই— দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বলে কেউ পদ ছাড়ছেন, এমন দৃশ্য বিরল। দুর্জনে অবশ্য বলবেন যে, কেজরীওয়াল বিলক্ষণ জানেন, তাঁর পক্ষে মুখ্যমন্ত্রিত্ব চালিয়ে যাওয়া দুষ্কর— তাঁর জামিনের শর্তই সে পথে প্রথম বাধা। অতএব, তিনি যমুনার ঘোলা জলেই যমুনাপুজোর কাজটি সেরে ফেললেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকা যেখানে কার্যত অসম্ভব, সেখানে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার মধ্যে যে রাজনৈতিক দৃশ্য রচিত হয়, কেজরীওয়াল তার লভ্যাংশটি নিজের ঝুলিতে পুরলেন। অতীশীর মুখ্যমন্ত্রিত্ব যে নিতান্তই সাময়িক ব্যবস্থা, সে কথাও গোড়াতেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, প্রত্যাবর্তনের পথ খুলেই তিনি পদত্যাগ করলেন। তাতে অবশ্য দূষণীয় কিছু নেই— বিশেষত, ভারতীয় রাজনীতি বর্তমানে যেমন ক্লেদসর্বস্ব হয়ে উঠছে, সেখানে কেউ রাজনৈতিক লাভের কথা মাথায় রেখেও একটি নৈতিক অবস্থান গ্রহণের দৃশ্য রচনা করলে তাকে স্বাগত জানানোই বিধেয়।
কেজরীওয়ালের জামিনের প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতি উজ্জ্বল ভুঁইয়া যে কথাগুলি বলছেন, তার তাৎপর্য গভীর। অনতিঅতীতেই যে দেশের শীর্ষ আদালত সিবিআই-কে ‘খাঁচার তোতা’ আখ্যা দিয়েছিল, সে কথা স্মরণ করিয়ে বিচারপতি ভুঁইয়া সিবিআই-এর গ্রেফতারির সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, যে মামলায় কেজরীওয়ালকে গ্রেফতার করা হল, সেটি ২০২২ সালের, এবং তাতে অভিযুক্ত হিসাবে কেজরীওয়ালের নাম ছিল না; ২০২৪ সালের ২৫ জুন প্রথম বার সেই মামলায় কেজরীওয়ালকে গ্রেফতার করার জন্য আবেদন করা হয়— অতএব, সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ইডির গ্রেফতারিতে জামিন পাওয়া সত্ত্বেও তিনি যাতে জেলের বাইরে না যেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতেই সিবিআই-এর এই পদক্ষেপ। মামলায় কেজরীওয়াল সহযোগিতা করছেন না, সে কারণেই তাঁকে হেফাজতে রাখা প্রয়োজন, সিবিআই-এর এই যুক্তি খণ্ডন করে বিচারপতি ভুঁইয়া বলেন, সিবিআই যে উত্তরটি চায়, কেউ ঠিক সে কথাগুলি না বললেই তিনি তদন্তে অসহযোগিতা করছেন বলে ধরে নেওয়া যায় না। মহামান্য বিচারপতির তিরস্কারে সিবিআই-এর বোধোদয় হবে, সে আশা করতে ভারতীয় নাগরিকের সম্ভবত সাহস হবে না। কিন্তু, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যে সম্পূর্ণ ভাবেই কেন্দ্রীয় শাসকদের হাতে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে, মহামান্য বিচারপতির তিরস্কারে সেই নাগরিক অভিযোগটির সারবত্তা প্রমাণিত হয়। একাধিপত্যকামী রাজনীতি দেশকে বিরোধীশূন্য করার পণ করতে পারে, কিন্তু সিবিআই বা ইডির মতো সংস্থা যদি সেই অভিযানের ইচ্ছুক দোসর হয়ে উঠতে থাকে, তবে তা গণতন্ত্রের পক্ষে অতি বড় দুঃসংবাদ।
গত এক দশকে এই তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে যে ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, এবং সংস্থাগুলি যে ভাবে নিজেদের ব্যবহৃত হতে দিয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তাদের সুনামের। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সংবাদমাধ্যম বা অসরকারি সংস্থা— গণতন্ত্রে যে স্বরগুলির গুরুত্ব অপরিসীম, সেগুলিকে দমন করার ক্ষেত্রে সিবিআই বা ইডির মতো সংস্থার নিয়মিত ব্যবহারের ফলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস হারিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত আদৌ নিরপেক্ষ হতে পারে। ফলে, যে কোনও ক্ষেত্রেই তদন্তভার এই সংস্থাগুলির হাতে ন্যস্ত হলে সংশয় তৈরি হচ্ছে যে, সে তদন্তের ফলাফল রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হবে। এই অবিশ্বাসের ফলে তৈরি হচ্ছে এক ভয়াবহ শূন্যতা— কাউকেই যদি বিশ্বাস না-করা যায়, তবে মানুষ ন্যায্যতার প্রত্যাশা করবে কোথায়? আর, সেই প্রত্যাশা না থাকলে সমাজ এগোবে কোন পথে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy