প্রতীকী ছবি।
কর্মহীনতা, দারিদ্র, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য, অকালমৃত্যু— অতিমারি তাহার দীর্ঘ ছায়া ফেলিয়াছে ভারতের জনসমাজে। তবে গভীরতম ক্ষতটি শিক্ষায়। প্রাথমিকের শিশু লেখাপড়া ভুলিয়াছে; মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ুয়া স্কুলে যাইবার পথ ভুলিয়া রোজগারে নিযুক্ত হইয়াছে। কলেজ যাইবার ইচ্ছাটিই ভুলিয়াছে বহু তরুণ-তরুণী। সংবাদে প্রকাশ, বাংলার মফস্সলের কলেজগুলিতে ভর্তির আবেদন কমিয়াছে। পূর্বে আসনসংখ্যার কয়েক গুণ আবেদন জমা পড়িত। এই বৎসর বহু কলেজে যত আসন, তত আবেদনও আসে নাই। বহু আসন শূন্য থাকিবার সম্ভাবনা প্রবল। এমনকি কন্যাশ্রী-সহ নানা ছাত্রভাতা পাইবার শর্ত পূরণ করিতে কলেজে নাম লিখাইবার যে হুড়াহুড়ি পড়িত, তাহাও এই বৎসর অনেক কমিয়াছে। কারণ, শিক্ষার্থীদের বড় অংশ উচ্চশিক্ষার আশা ত্যাগ করিয়াছে। তাহারা নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচাইতেই নাজেহাল। সেই তাগিদ কখনও তাহাদের ভিন্রাজ্যে লইয়া যাইতেছে, কখনও স্বামীর গৃহে। হয়তো অতিমারি কখনও নিয়ন্ত্রিত হইবে, অর্থনীতি ছন্দে ফিরিবে, কিন্তু শিক্ষাবিযুক্ত এই ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গনে ফিরিবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
এই বিপরীত গতিকে বুঝিতে চাহিলে কেবল অর্থনীতির সঙ্কট নহে, উচ্চশিক্ষার সঙ্কটেরও মুখোমুখি দাঁড়াইতে হইবে। দরিদ্র পরিবার চিরকাল দারিদ্র অতিক্রম করিতে শিক্ষাকেই অবলম্বন করিয়াছে। শিক্ষাকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করিবার মানসিকতা অন্তত পশ্চিমবঙ্গ কখনও দেখে নাই। স্বাধীনতা তথা দেশভাগের পরে বাংলায় দুঃসময় কম আসে নাই, দারিদ্রও সহজে যায় নাই। কিন্তু স্বল্পবিত্ত পিতামাতাও বহু আত্মত্যাগ করিয়া সন্তানকে পড়াইয়াছেন। আজ কি কেবল আর্থিক দৈন্যই উচ্চশিক্ষা হইতে মুখ ঘুরাইবার কারণ? না কি, যে আশায় বুক বাঁধিয়া দরিদ্র পরিবার সন্তানকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পড়াইয়াছে, উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে সেই আশাটিই ভাঙিয়াছে? কলেজের সহিত শিক্ষা, এবং শিক্ষার সহিত উন্নত জীবনের সম্পর্ক ক্রমশই ক্ষীণ হইয়াছে। বিশেষত মফস্সলের কলেজগুলি অধিকাংশই পরীক্ষা দিবার ও ডিগ্রি পাইবার কারখানা হইয়া রহিয়াছে। কখনও পরিকাঠামো ও শিক্ষকের অভাবে, কখনও শৃঙ্খলা এবং নিষ্ঠার অভাবে পঠন-পাঠনের নিয়মরক্ষাই কেবল হইতেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কলেজের শিক্ষার সহিত ছাত্রের অন্তরের যোগ নাই, তাহার জীবনযাপনের কোনও সংস্পর্শ নাই। পেশাদারি দক্ষতা তৈরি করিতে, অথবা জীবনাদর্শ গড়িয়া দিতে অধিকাংশ কলেজ অপারগ, অনাগ্রহী। তাই ছাত্রেরাও কলেজের শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।
তা সত্ত্বেও প্রতি বৎসর ভর্তির মরসুমে কলেজগুলিতে আসন লইয়া কাড়াকাড়ি পড়িত। তাহার অন্যতম কারণ, তরুণ-তরুণীদের সম্মুখে বিকল্পের অভাব। স্কুলের পাঠ সম্পূর্ণ করিয়া কাজের যথেষ্ট সুযোগ নাই, তাই কলেজে নাম লিখাইয়া তাহারা অপেক্ষা করিত। অকারণে অনাগ্রহের বিষয় মুখস্থ করিত ও পরীক্ষায় লিখিত। সেই কারণেই, মারিপীড়িত সময়ে তাহারা শিক্ষাকে অনাবশ্যক বোঝা মনে করিয়া ছুড়িয়া ফেলিয়াছে, তাহাকে অবলম্বন করিয়া উন্নত জীবনের সন্ধানের কথা মনে হয় নাই। সরকারি কলেজের শিক্ষা হয়তো দুর্মূল্য নহে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা কলেজে দুর্লভ। কলেজের শূন্য আসন শিক্ষার্থীর আস্থাশূন্যতার প্রকাশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy