মন্ত্রী অমিত শাহ খুঁজে পাননি। মৌর্য, গুপ্ত, চোল, চালুক্য ইত্যাদি রাজত্বের খোঁজ তিনি নাকি পাঠ্য বইতে পাননি। সব ইতিহাস পাঠ্যে নাকি কেবল একই জিনিস ভূরি ভূরি: মোগল সাম্রাজ্যের কীর্তিকাহিনি। সুতরাং মন্ত্রী বিস্তর চটেছেন। হাঁক পেড়েছেন, নতুন করে ইতিহাস লেখা হোক, দেখি কে কী করতে পারে। এত বড় পদে আসীন থেকে যে ইতিহাস নিয়ে কেউ এমন মিথ্যাভাষণ করতে এবং এমন হুঙ্কার তুলতে পারেন, দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। নতুন করে বিস্মিতও হতে হয় এ কথা জেনে, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী— যাঁর কাছে দেশের সব রকম তথ্যই মজুত থাকার কথা— তিনি জানতে পারেননি যে দেশের স্কুলপাঠ্য বই থেকে স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রম, সর্বত্রই কেবল পাঁচ-দশ শতাংশ মোগল ইতিহাস, বাকি নব্বই থেকে পঁচানব্বই শতাংশ অন্যান্য ইতিহাস। জানতেই পারেননি— যে রোমিলা থাপারকে তিনি এবং তাঁরা গত কয়েক বছর অবিশ্রান্ত ডাইনিতাড়না করে ফিরেছেন, সেই রোমিলা ও তাঁর মতো গবেষকরা প্রাচীন রাজতন্ত্রগুলি সম্পর্কে কত অজানা অচেনা তথ্য জনসমক্ষে তুলে এনেছেন। কত শ্রমসাধ্য গবেষণায় ইতিহাসবিদরা কত আঞ্চলিক ইতিহাস-বিবরণী লিখেছেন। মজার বিষয়, কোন সাম্রাজ্যের গৌরব কম, কোনটির বেশি, এ নিয়ে আজ অমিত শাহ মহাশয় হুঙ্কারমত্ত। এ দিকে কত দিন আগে ভারতের ইতিহাসবিদরা গ্রহণ করেছেন বিশ্বকবির সেই অমোঘ মানবিক ইতিহাসদর্শন: ‘শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-’পরে/ ওরা কাজ করে’। না গবেষক, না গোয়েন্দা, কেউই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ সব জানিয়ে উঠতে পারেননি। তাই দেশের আর্থিক সামাজিক রাজনৈতিক বড় বড় সমস্যা ফেলে তিনি এখন পাল্টা ইতিহাস রচনায় অবতীর্ণ হচ্ছেন সেই পরিচিত ঢং-এ, পেশিপ্রয়োগের পন্থায়।
রাজনৈতিক নেতা এ ভাবে ‘পাল্টা নেওয়া’র হাঁক দিলে ইতিহাস রচনার পক্ষে স্বভাবতই তা শ্রেয় ও স্বচ্ছন্দ পরিস্থিতি হতে পারে না। ইতিহাসবিদরা অবশ্য বলছেন যে, অমিত শাহের বক্তব্যকে এত গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই— দিলে প্রাপ্যের বেশি মনোযোগ তাঁরা পেয়ে যাবেন, তাঁদের প্রচার আরও বাড়বে। তবে এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, ভারতীয় নাগরিক সমাজ যে ভাবে ক্রমেই শিক্ষার পরিমণ্ডল থেকে সরে আসছে, এবং সমাজমাধ্যমের সুচারু ব্যবহারে ক্ষমতাবানরা যে ভাবে তাঁদের মস্তিষ্কমহল দখল করছেন যে, ভুল প্রচারের বিরোধিতা করাটাও এখন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়। এই হল সত্য-উত্তর যুগের মহাসঙ্কট: এ পক্ষের নীরবতা সহজেই ও পক্ষের মিথ্যাপ্রচারের প্রধান সহায় হয়ে উঠতে পারে।
ভারতীয় নাগরিক ক্রমেই এঁদের কাছে শুনবেন, শিখবেন ও জানবেন— যে রাজারা ভারতের বিভিন্ন অংশে শাসন করেছেন, সকলেই আসলে ‘সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মৌর্য, গুপ্ত কিংবা মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে অন্যান্য রাজত্বের আকারগত ও প্রকারগত পার্থক্য তাঁরা জানবেন না। পুরনো সাম্রাজ্যের সঙ্গে পরবর্তী ব্রিটিশ ভারত সাম্রাজ্যের যে বিশেষ তফাত, তা-ও জানবেন না। অথচ একই সময়ে এ দেশে বিবিধ শাসন জারি ছিল, পাশাপাশি সহাবস্থানে তারা পারদর্শী ছিল, এমনকি ‘সাম্রাজ্য’গুলিও সেই ‘রাজত্ব’গুলিকে সম্মান এবং স্বীকৃতি দিয়ে চলত— এর মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে ভারতের প্রকৃত বহুত্ববাদের ইতিহাসটি। এ কথা অস্বীকার করতে চান বলেই অমিত শাহেরা নাগরিকদের ভুল ইতিহাস শেখান, সবই তাঁদের কাছে ‘সাম্রাজ্য’ হয়ে যায়, কালক্রমে হয়তো নিজেদের শাসনতন্ত্রটিও! অতীতের পাল্টা ভাষ্য রচনা যে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের কাছে কতটা প্রিয় ও জরুরি প্রকল্প, সেটা মনে রাখা বর্তমান রাজনৈতিক ধারাটি বোঝার জন্যই দরকার। ইতিহাস তাঁদের কাছে কেবল ক্ষমতার উচ্চতা বাড়ানোর কারসাজি। ইতিহাস পাঠ্য নিয়ে তাঁরা সত্যের ধার ধারবেন কেন। ‘সত্য’পথে তো আর ক্ষমতারথ ছোটানো যায় না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy