Advertisement
E-Paper

‘সব পেয়েছির দেশ’?

একুশ শতকে এসে এখন মানুষের হাতে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা এআই। তার প্রয়োগক্ষমতা মালুম হচ্ছে শিক্ষা রাজনীতি বিনোদন ক্রীড়া অর্থনীতি— সর্বত্র।

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৫ ০৫:৫৭
Share
Save

বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ— এ নিয়ে একদা স্কুল স্তরে প্রবন্ধ লিখতে হত। সে ছিল বিশ শতকের শেষার্ধ— বিশ্বায়ন ও মুক্ত অর্থনীতি তখন দেশের সামনে নানা সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সম্পর্কে বাড়ছে কৌতূহল। সঙ্গী ছিল সংশয়ও। তথ্যের ধ্রুপদী ভূমিকা সম্পর্কে অবগত ছিল সমাজ, কিন্তু কম্পিউটার এসে তথ্যের ব্যবহারের ভূমিকাটাই দিচ্ছিল পাল্টে; বোঝা যাচ্ছিল, মানুষের তৈরি যন্ত্র মানুষেরই হাতে হয়ে উঠতে পারে রক্ষক ও ভক্ষক দুই-ই। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তো কত আগে লেখা সাহিত্য, তবু তার শেষ কথাটি প্রতিভাত হচ্ছিল: কখনও রোবটকে কেন্দ্র করে জন-উত্তেজনা ও উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশে, কখনও শিক্ষাক্ষেত্র ও প্রশাসনে কম্পিউটারের ব্যবহার নিয়ে দেশ বা রাজ্যের নীতি-নির্ধারকদের আচরণে। সে দিন গিয়েছে, একুশ শতকে এসে এখন মানুষের হাতে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা এআই। তার প্রয়োগক্ষমতা মালুম হচ্ছে শিক্ষা রাজনীতি বিনোদন ক্রীড়া অর্থনীতি— সর্বত্র। সঙ্গে এও বোঝা যাচ্ছে, এ জিনিস এতই নতুন যে এখনও তার অনেক কিছুই অজানা।

প্যারিসে গত মাসে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাকশন সামিট’ নামে সম্মেলন হয়ে গেল, সেখানে এই ‘নতুন’কে ঘিরে সংশয় ও সম্ভাবনার মিশ্র প্রতিক্রিয়াই উঠে এল। এআই কি প্রকৃত অর্থেই বন্ধু, না কি বৈর; সে কি সমষ্টিজীবনকে সহজ করতে এসেছে, না কি বাছাই কিছু মানুষ ও গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধিতে— এই সংশয় সেখানে ধ্বনিত হয়েছে বারংবার। এই সংশয় আসলে গণতন্ত্র নিয়ে— এআই ও গণতন্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্কটি কোন দিকে গড়াবে তা নিয়ে। এআই সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানেন ভাসা-ভাসা, অধিকাংশের কাছেই এ হল স্রেফ ‘আরও একটি’ প্রযুক্তি, যার সহায়ে জীবন অনেক সহজ হবে। সহজ হয়েছেও— স্মার্টফোন-কম্পিউটার থেকে যানবাহনে রাস্তা চেনার পথনির্দেশ ইত্যাদি এআই-এর জাদুকাঠির ছোঁয়ায় দিনকে দিন হয়ে উঠছে অত্যন্ত উন্নত, ব্যবহার-বান্ধব। সমাজমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে হালকা হাসিঠাট্টাও: এআই-কে শেক্সপিয়রের মতো কবিতা লিখতে বলা হলে সে চোখের নিমেষে স্ক্রিনে হাজির করছে শেক্সপিয়রগন্ধী কোনও চতুর্দশপদী; জীবনানন্দ দাশেরও এআই অবতারে উপস্থিত হওয়াটা হয়তো সময়ের অপেক্ষা কেবল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা এআই-এর সাহায্যে ব্যাপক উপকৃত হচ্ছেন ও হবেন, এই কথাটি বলছেন শিক্ষাক্ষেত্রে এআই নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা। এআই-ছোঁয়ায় যে কেউ পেতে পারেন কাঙ্ক্ষিত চেহারা ও রূপ— অন্তত সমাজমাধ্যমে। এআই এক ‘সব পেয়েছির দেশ’, একুশ শতকে মানুষের ইহজীবনের যাবতীয় ইচ্ছাপূরণের ‘সবচেয়ে গণতান্ত্রিক’ পন্থা— প্রচার করছে এআই সংস্থাগুলি।

গণতন্ত্রের মূল সুরটি বৈষম্যহীনতার। এআই-এর সুফল আর্থ-সামাজিক স্তরনির্বিশেষে সকল দেশে ও সমাজে সব মানুষের কাছে সমান ভাবে পৌঁছলে তবেই তার গণতান্ত্রিকতার দাবিটি অন্তত মোটাদাগেও করা যেতে পারে। সে সময় যে এখনও আসেনি তা নিয়ে সন্দেহ নেই, তবে তা আদৌ আসবে কি না তা নিয়েও নিঃসংশয় হওয়া যাচ্ছে না। প্যারিসের সম্মেলনে উন্নত বিশ্বের প্রথম সারির রাষ্ট্রনেতারাই গণতন্ত্রের প্রচার-প্রসারে এআই-এর ভূমিকা নিয়ে এখনও সন্দিহান, উদাহরণ হিসেবে অনেকেই তুলে ধরেছেন ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে সম্প্রতি সাধারণ নির্বাচনে এআই-এর ব্যবহার। দেখা যাচ্ছে, অনেক সময়েই ব্যক্তি (প্রভাবশালী প্রার্থী) কিংবা বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগানো হচ্ছে এআই-কে: ‘রেকমেন্ডেশন অ্যালগরিদম’, সমাজমাধ্যমের ‘কোঅর্ডিনেটেড অ্যাকাউন্ট’, ‘পেড প্রোমোশন’ ইত্যাদির মাধ্যমে। এই সবই আম-জনতার সহজবোধ্য নয়, অথচ তাঁদের বহুলাংশ সমাজমাধ্যম-সহ তথ্য-প্রযুক্তির আধুনিক মাধ্যমগুলির ভোক্তা। নিজেদের অজানতেই তাঁরা ব্যক্তি, দল, এমনকি রাষ্ট্রেরও ক্রীড়নক হয়ে উঠতেই পারেন। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারণা, টাকা হাতিয়ে নেওয়া বা সম্মানহানি ইত্যাদির ভূরি ভূরি উদাহরণ এখনই চোখের সামনে, এআই-এর ব্যবহার আরও সহজ ও সুগম হলে এই শঠতা আরও ছেয়ে যাবে বলে আশঙ্কা। সবচেয়ে বড় কথাটি ‘নৈতিকতা’র— এআই গবেষণা সংস্থা ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রগুলি এআই-নীতি নিয়ে তবু যতটা উৎসাহী, এআই-নৈতিকতা নিয়ে তার ক্ষুদ্র শতাংশও নয়। তাই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আড়ালে সর্বাধিক অনৈতিক শোষণের প্রশ্নটি থেকেই যাবে। ভবিষ্যৎই বলবে, কোথায় এর সদুত্তর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

AI Artificial Intelligence

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy