Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
BJP

ক্ষমতার হুঙ্কার

মুখ্য বাস্তব হল, সর্বগ্রাসী দলতন্ত্রে শাসক দলের ক্ষমতাবান নেতার উপদেশ পুলিশকে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার প্ররোচনা দিলে রাষ্ট্রক্ষমতার গণতান্ত্রিক রক্ষাকবচগুলি আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:১৫
Share: Save:

কলকাতার পুলিশ মঙ্গলবার শহরের বুকে অশান্তির মোকাবিলায় যে ‘সংযম’ দেখিয়েছে, তার প্রশংসা করেছেন রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ও সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শাসক দলের উদীয়মান নেতার মুখে পুলিশি সংযমের গুণগান শুনে নাগরিকরা আশ্বস্ত হতে পারতেন। কিন্তু তেমন স্বস্তি এই রাজ্যের প্রজাকুলের কপালে নেই। সংযমী পুলিশকে কুর্নিশ করার পরেই তরুণ সাংসদের দৃপ্ত ঘোষণা: তিনি যদি ওই অফিসারের জায়গায় থাকতেন, ‘আর আমার সামনে যদি পুলিশের গাড়িতে আগুন জ্বলত বা পুলিশের উপর এই ভাবে হামলা হত’, তা হলে আক্রমণকারীর কপালের মধ্যস্থল নিশানা করে গুলি চালাতেন তিনি। শুনে নাগরিকের মনে যুগপৎ আতঙ্ক এবং বিস্ময়ের উদ্রেক হতে পারে। আতঙ্ক, কারণ এমন সুসমাচার শুনে পুলিশের কর্তা ও কর্মীরা যদি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন? বিস্ময়, কারণ কপাল লক্ষ্য করে গুলিচালনাই যদি তিনি ‘আমার নীতি’ বলে স্থির করে থাকেন এবং সেটা সগর্বে জাহির করেন, তা হলে আর সংযমের জন্য পুলিশকে কুর্নিশ করার অর্থ কী?

অভিষেকবাবু বা তাঁর স্বজনবান্ধবরা হয়তো যুক্তি দেবেন, সারা দিনের ঘটনায়, বিশেষত আহত পুলিশ অফিসারকে হাসপাতালে দেখে তিনি রাগের মাথায় এমন কথা বলে ফেলেছেন। রাগের কারণ থাকলে রাগ হতেই পারে, কিন্তু সেই রাগকে কী ভাবে প্রকাশ করা যায় তার কিছু ন্যূনতম বিধি আছে। এক জন জনপ্রতিনিধি, বিশেষত শাসক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী নেতা নিজের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারুন, জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না? বাক্‌সংযম অস্ত্রসংযম অপেক্ষা কম জরুরি নয়। কিন্তু অনেক বড় প্রশ্ন হল, এই উক্তি কি নিছক অসংযত ক্রোধেরই প্রকাশ? এমন আশঙ্কাও একেবারেই অস্বাভাবিক নয় যে, এতদ্দ্বারা বক্তা একটি বার্তা দিতে চাইছেন। ক্ষমতার বার্তা। নিয়ম, নিয়ন্ত্রণ, সংযম, সব কিছু যে ক্ষমতার কাছে তুচ্ছ। যে ক্ষমতা কোনও শর্ত বা রক্ষাকবচকে মনে মনে মানতে চায় না, কারণ মানতে গেলে নিজেকে খর্ব করতে হয়। উদীয়মান দলনেতা কি সেই নিরঙ্কুশ আধিপত্য-অভিলাষী ক্ষমতার প্রতিমূর্তি রূপে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আবির্ভূত? ইতিমধ্যেই?

এই মূর্তি অপরিচিত নয়। বিশেষত পুলিশের প্রতি ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের উচ্চারণে বারংবার বিপুল অসংযমের পরিচয় মিলেছে। কোনও নায়ক নির্মম কৌতুক সহকারে প্রশ্ন তুলেছেন, হিংসা দমন করতে পুলিশ কি গুলি না ছুড়ে মিষ্টান্ন ছুড়বে? কেউ বা কোনও কৌতুকের তোয়াক্কা না করে ঘোষণা করেছেন, পুলিশ দরকার হলে ‘ওদের’ উড়িয়ে দিক, মানবাধিকার ইত্যাদির ব্যাপার তিনি দেখে নেবেন। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। কিন্তু অতীতের তুলনায় আজ তা আরও অনেক বেশি বিপজ্জনক। তার কারণ, দলতন্ত্র এখন সম্পূর্ণ নিরাবরণ, পুলিশ প্রশাসন তার কাছে কেবল নতজানু নয়, সাষ্টাঙ্গে শয়ান, শাসক দলের স্থানীয় গুন্ডারা থানায় চড়াও হলে পুলিশকে টেবিলের নীচে আশ্রয় নিতে হয়। রাজ্য প্রশাসনের কেউ না হয়েও পুলিশকে ‘উপদেশ’ দেওয়া যায় কি না, সেটা গৌণ প্রশ্ন। মুখ্য বাস্তব হল, সর্বগ্রাসী দলতন্ত্রে শাসক দলের ক্ষমতাবান নেতার উপদেশ পুলিশকে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার প্ররোচনা দিলে রাষ্ট্রক্ষমতার গণতান্ত্রিক রক্ষাকবচগুলি আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রীর উক্তিটিও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, পুলিশ বুধবারের ঘটনায় ইচ্ছা করলে গুলি চালাতে পারত, কিন্তু পুলিশ গুলি চালাক এটা কাম্য নয়। ভয় হয়, এমন বক্তব্য প্রকারান্তরে গুলিচালনার ‘যুক্তি’ না-হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে প্রবীণ দলনেত্রীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে নবীন সহনায়কের হুঙ্কার নাগরিকের কানে বহুগুণ বেশি উদ্বেগজনক শোনাচ্ছে।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP TMC Abhishek Banerjee Nabanna Abhijan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy