রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নীচে চলে গিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র, এবং গুরুতর আহত, রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হচ্ছে: এই ছবি এখন পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম গৌরবফলক। শিক্ষামন্ত্রীকে মানতে হবে, এই রাজ্যে ছাত্র-রাজনীতির দীর্ঘ ও বিপুল ইতিহাসেও অভূতপূর্ব ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন তিনি। ওই তুঙ্গমুহূর্তটির আগে ও পরে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, বিভিন্ন দলের ও পক্ষের ছাত্ররা যত তাণ্ডবই করুক না কেন— কোনও দোহাই দিয়ে, কোনও অজুহাতেই এই ভয়ঙ্করতার ব্যাখ্যা চলে না। শনিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা মন্ত্রীর কাছে/বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে পারেন, অশান্তি ও সংঘর্ষ হতে পারে, এই পূর্বাভাস সম্ভবত তাঁর কাছে ছিল। যদি না থেকে থাকে, তবে সে দায় তাঁর। বিক্ষোভ তীব্র হলে কী ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, তাঁরই ভাবার কথা ছিল। যদি তিনি তা না ভেবে থাকেন, তবে সে দায়ও তাঁর, সে ক্ষেত্রে এ রাজ্যে মন্ত্রী, এমনকি নেতা হওয়ার প্রাথমিক শর্তটিই তিনি পূরণ করতে অপারগ। বিক্ষোভ ও তাণ্ডবকে ‘নৈরাজ্য’ বলে দাগিয়ে দিয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ভিতর দিয়ে, এবং কার্যত তাদের শরীরের উপর দিয়ে, গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা কোনও জননির্বাচিত নেতা করতে পারেন না।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু নাকি পুলিশ ডাকতে নারাজ ছিলেন। শিক্ষাঙ্গনে পুলিশ ডেকে আনলে তার ফল এই রাজ্যে কী দাঁড়ায়, সরকার ও বিক্ষুব্ধ বা বিরোধী সকলেই তা ভালমতো অবহিত। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে কোনও ছাত্র গাড়ির চাকায় পিষ্ট বা আহত হলে যে কেবল ছাত্রসমাজ নয়, সমগ্র নাগরিক সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে, তা তাঁর বিবেচনায় ধরা পড়ল না? পড়ল না কেন, তার সম্ভবত একটিই উত্তর— চোখে ক্ষমতাঞ্জন থাকলে মানুষকে আর মানুষের মতো লাগে না। অবশ্যই, এই তাণ্ডব পরিকল্পিত, যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি একাধিক বার দেখা গিয়েছে। এই হিংসাত্মক বিশৃঙ্খলা বামবাদী ছাত্র-রাজনীতি ও সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঐতিহ্যেরই অভিজ্ঞান— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস যে রাজনীতির বিশদ ও গভীর পাঠ নিয়ে অত্যন্ত উপকৃত হয়েছেন, এবং এখন বঙ্গীয় বিজেপি-আরএসএস দ্রুতবেগে তার সার্থক পাঠ নিচ্ছে। রাজ্যের শাসককে এর মোকাবিলা করতে হবে, গত্যন্তর নেই।
মোকাবিলার ইচ্ছা থাকলে সর্বপ্রথমেই প্রশ্ন ওঠে— শিক্ষাঙ্গনে এতখানি ক্রোধ-ক্ষোভ-হতাশা-অসহায়তা জমতে পারল কেন। ওয়েবকুপার বৈঠক ছত্রভঙ্গ করে বাম ছাত্রনেতারা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন ছাত্র সংসদের ভোটের দাবি নিয়ে, যাকে অনেকে ঝামেলা তৈরির বাহানা বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ‘বাহানা’টি তৈরি করা গেল এ জন্যই যে, আপাতভাবে রাজনীতির আখড়া ভাঙার লক্ষ্যে রাজ্যের কলেজগুলিতে সাত বছর, এবং যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। এ দিকে প্রতি ক্যাম্পাসে ক্ষমতাধর ছাত্রনেতারা যদৃচ্ছ ছড়ি ঘোরান, শিক্ষা-পরিকাঠামো বা শিক্ষা-পরিবেশের তোয়াক্কা না করে নিজেদের খুশিমতো অর্থ নয়ছয় করেন— এর মধ্যে রাজনীতি নেই? বাইরের রাজনীতির অনুপ্রবেশ নেই? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং-এ ছাত্রমৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনার তদন্তের গতিপ্রকৃতি কী বলে? এ সবই কি আসলে সরকারের স্বার্থরক্ষার কৌশল নয়? বকলমে শাসক গোষ্ঠীর প্রাধান্য বজায় রাখার পদ্ধতি নয়? শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁর নেত্রী এ বিষয়ে কতটা অনমনীয়, ছাত্ররাও জানে। এই ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের উৎস সেখানেই। সুতরাং, এ কেবল ছাত্র সংসদের প্রশ্ন নয়, স্থিতাবস্থার নামে শাসকপোষিত অচলাবস্থা জারি রাখার দীর্ঘ কৌশল। শনিবারের কুনাট্যের পর উইঙ্কল টুইঙ্কল নাটক-স্রষ্টা শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁর নেত্রীর কি মনে পড়ছে ক্ষমতান্ধতা ও চোরাবালির সেই নাটকীয় অনুষঙ্গ?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)