অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টি যে কত জরুরি, ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার চল্লিশ বছর পূর্তিতে সে কথাটি উপলব্ধি করা গেল আরও এক বার। ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইড সংস্থার কীটনাশক নির্মাণকারী প্লান্ট থেকে বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে কারখানা ও সংলগ্ন জনবসতির বাতাসে, অসহ্য যন্ত্রণায় ও দমবন্ধ হয়ে অচিরেই মৃত্যু হয় অগণিত নারী পুরুষ শিশুর। বেসরকারি হিসাবে প্রথম সপ্তাহেই মৃত্যু ছাড়িয়েছিল আট হাজার। আজ জানা যাচ্ছে, বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে সেখানে ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন, উপরন্তু স্থায়ী রোগব্যাধি ও শারীরিক নানা সমস্যা নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে পরবর্তী একাধিক প্রজন্ম। ইতিহাসের বইয়ে সবিস্তারে লেখা থাকে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমার ধ্বংসলীলা, বীভৎসতার নিরিখে ভোপালও কিছু কম নয়। তফাত শুধু প্রেক্ষাপটের: একটি যুদ্ধের আবহে জেনেশুনে নেওয়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, অন্যটি কর্তৃপক্ষের চরম অসাবধানতার।
চার দশক পরে আজ চোখের জলে স্মরণ করা হচ্ছে ভোপালে প্রাণ হারানো মানুষগুলির, স্মারক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে। সে দিনের ট্র্যাজেডি মনে রাখার কাজটি জরুরি, নইলে মানবিকতাই প্রশ্নের মুখে পড়ে। কিন্তু তার পরেও কয়েকটি প্রশ্ন তুলে ধরা দরকার, যেগুলি একাধারে রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, মানবাধিকার এবং সর্বোপরি চিকিৎসা ও বিজ্ঞান-গবেষণা— প্রতিটি ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। দুর্ঘটনার পর কারখানাটি স্থায়ী ভাবে বন্ধ করা দেওয়া হলেও, জানা যাচ্ছে আজও সেই চত্বরের ভিতরে গেলে রাসায়নিক গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়, ভিতরের ‘সোলার পন্ড’টি আজও রাসায়নিক বর্জ্যে ভরা, দূষিত ও সম্ভবত প্রাণঘাতী। আজও এই এলাকার চার পাশ জনবসতিপূর্ণ, কারখানার কাছেই মাঠে খেলা করে শিশুরা, যাদের অনেকেই সেই দুর্ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের জেরে হাঁপানি, হৃদ্রোগ, চর্মরোগ-সহ শরীরের বাড়বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা-প্রতিরোধী নানা সমস্যায় জর্জর। চুরাশির দুর্ঘটনাগ্রস্ত সাধারণ মানুষের ক্ষতিপূরণ নিয়ে আজও বিস্তর অভিযোগ, বিশেষ কার্ড দেওয়া হলেও আর্থিক সাহায্য মেলেনি।
চার দশক আগে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা আজকের মতো ছিল না। ভোপালের দুর্ঘটনা রাসায়নিক গ্যাস সংক্রান্ত বলেই হওয়া দরকার ছিল তা নিয়ে বিশদ বিজ্ঞান-গবেষণা, তাও হয়নি। সে দিন যে চিকিৎসকেরা ভোপালের হাসপাতালে টানা দিন তিন ধরে শত শত শবব্যবচ্ছেদ করেছিলেন তাঁদের আক্ষেপ, এই রাসায়নিক গ্যাসের চরিত্র নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন ছিল: কোন গ্যাস কতটা দূরত্ব পেরোচ্ছে তা চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করে বলা যেতে পারত, কোনটি শরীরের কোন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে, কী ভাবে। সেই ক্ষতি কী করেই বা ঠেকানো যেতে পারে, পাওয়া যেত সেই পথও। যে মানুষেরা বিনা দোষে প্রাণ দিলেন তাঁদের তো ফিরে পাওয়া যাবে না, কিন্তু যাঁরা আজও বেঁচে আছেন শারীরিক মানসিক রোগব্যাধি সয়ে, তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্যও সেই বিজ্ঞান-গবেষণাটুকু প্রয়োজন ছিল। সর্বোপরি, ভবিষ্যতে এ রকম বিপর্যয় হলে কোন পথটি নিতে হবে, সেই মোকাবিলার প্রস্তুতি হল না— চল্লিশ বছরেও। অর্থনৈতিক সুবিধা বা মানবাধিকারের লঙ্ঘন যেমন হল, তেমনই পিছিয়ে গেল চিকিৎসাবিজ্ঞানও: দুর্ভাগ্যের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy