মাঝেমাঝে খুব হাতে লিখতে ইচ্ছে করে। অক্ষরগুলো আঙুল দিয়ে তৈরি করতে ইচ্ছে করে সাদা পাতায় বা কখনও রুলটানা পৃষ্ঠায়। লিখতে গিয়ে ভুল হলে এক টানে সে লেখা কেটে নতুন শব্দ আঁকতে ইচ্ছে করে। নীল, কালো, সবুজ কলমের টানে তৈরি করতে ইচ্ছে হয় একটা পুরো গল্প। বা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে ভালবাসার মানুষটিকে। হ্যাঁ, নিজের হাতে লিখতে ইচ্ছে করে!
কলম বনাম ইঁদুর
কিন্তু এই ডিজিটাল ভারতে আমার সে ইচ্ছে কি আর পূরণ হবে? সবাই শুনলে জুটবে না তো ‘ব্যাকডেটেড’ তকমা! বলবে না তো, কোথায় যুগ তরতর করে এগোচ্ছে আর আমি কিনা তাকে টেনে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি! বলতেই পারে। আসলে, যখন লেখালিখির জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়, ততদিনে ধীরে ধীরে সাদা পাতায় নতুন একখানা গল্প লেখার অভ্যাস ‘গল্প’ হওয়ার পথে পা বাড়িয়ে ফেলেছে। সকলের সুবিধার্থে মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার বা ল্যাপটপেই শুরু হয়ে গিয়েছে অক্ষর টাইপ করার চল।
অনেকটা সাঁতার না জেনে সুইমিং পুলে নামার উপক্রম হয়েছিল! বিদেশে দেখা যায়, ছোট বাচ্চাকে ছেড়ে দেওয়া হয় সুইমিং পুলে আর চেষ্টা করতে করতে নিজেই সে শিখে নেয় সাঁতারের কৌশল। তেমনই অবস্থা হল আমার! একটা সবে গল্প লিখেছি বাংলা অক্ষরে, সাদা খাতায়। শোনা গেল, এখন থেকে টাইপ করে পাঠাতে হবে সব জায়গায়, হাতে লেখা বয়ান আর গ্রাহ্য হবে না।
লোকমুখে তারিফ শুনে এসেছি নিজের হাতের লেখার! সুনাম ছিল বলে কত স্টাডি নোট কপি করার দায়ভার আমার উপর বর্তাত! শেষে এখন কিনা কালি-কলমকে জীবন থেকে ‘ডিলিট’ করে দিয়ে হাতে তুলে নিতে হবে কি-প্যাড আর মাউজ়?
একটা দু’হাজার বা তিন হাজার শব্দের গল্প কি-প্যাডে লিখতে হবে ভেবে ‘এনার্জি’ শেষ হয়ে গিয়েছিল শুরুতেই! নানা ধরনের বাংলা ফন্টের নামগুলোকে হিব্রু বলে মনে হত তখন! অনেকটা ‘তারে জ়মিন পর’ ছবির ইংরেজি অক্ষরগুলোর এদিক ওদিক শূন্যে ভেসে থাকার মতো! ততদিনে মেসেজ পালটে হয়ে গিয়েছে হোয়াটস্অ্যাপ। চিঠি লেখার ডিজিটাল ফর্ম। কিন্তু ওই যে ২৪ বছরের প্রেমিকের লেখা গোটাগোটা অক্ষরের প্রেমপত্র, যার গায়ে লেগে থাকত ছেলেটির হাতের ছোঁয়া, ভালবাসায় মোড়া সেই চিঠি নেওয়ার জন্য কত ঝড়জল পেরিয়ে ২২ বছরের তরুণী নির্দিষ্ট জায়গায় দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করত, সেই অপেক্ষার কদর কি দূরকে এক নিমেষে কাছে টানার অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত এখনকার প্রজন্ম জানবে কোনওদিন?
হ্যাঁ, গাছ কাটার বিরোধী আমি। চাই না, আর গাছ কাটা হোক কাগজ তৈরির জন্য। বরং মনেপ্রাণে চাই যে, রিসাইকেল হোক, পুনঃব্যবহৃত হোক কাগজ। তেমন ভাবেই বহুতল বানানোর জন্যও যেন গাছ কাটা না পড়ে। তথাকথিত উন্নয়নের জন্য সাদামাঠা কাগজকে আত্মবলিদান দিতে হবে কেন?
ডিজিটাল ভাবাবেগ
বাচ্চাটি চেষ্টা করতে করতে জলে হাত-পা চালানো শিখে গিয়েছে অবশেষে। বুঝে গিয়েছে, পাড়ে বসে থাকলে কিচ্ছু এগোবে না, কষ্ট করে হলেও শিখতে হবেই। অতএব, শিখে গেলাম টাইপিং, জড়তা নিয়েই হাত চালাতে থাকলাম, মনে আসা গল্পের গতিবেগের সঙ্গে পেরে উঠত না আঙুলের স্পিড। রাগ হত।
দেখতাম, এক কোনে পড়ে থাকা অভিমানী কলম আর কাগজ আমার দিকে তাকিয়ে! তাদের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আবারও হাতে তুলে নিতে হল কি-প্যাড!
এই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে কলেজের প্রথম বর্ষের ইতিহাস ক্লাসের তৃতীয় সারিতে বসে থাকা ফুলছাপ নীল সালোয়ার-কামিজের মেয়েটির ব্যাগে লুকিয়ে রেখে দেওয়া রোগা টিং-টিঙে হলুদ পাঞ্জাবি পরা কেমিস্ট্রির ছাত্রটির লেখা তিন শব্দের প্রথম চিরকুট! কিংবা বই ধার নেওয়ার ছলে বইয়ের ১৪৩ নম্বর পাতায় যত্ন করে গুঁজে দেওয়া প্রথম প্রেমপত্র!
এখন এক সেকেন্ডে মনের ভাব প্রকাশের পথে আসে না কোনও জড়তা। মোবাইল স্ক্রিনে টপাটপ মনের কথা লিখে ভালবাসার মানুষটির কাছে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। পার হতে হচ্ছে না কয়েকশো কিলোমিটার রাস্তা, যেতে হচ্ছে না নিদেন ডাকঘর অবধিও!
অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে সব কিছু। সম্পর্কের দূরত্বগুলো কাছাকাছি চলে এসেছে। অথবা হয়তো অনেক দূরে চলে গিয়েছে বেশি কাছে আসতে গিয়ে! কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে বেশ সুবিধাই যে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। নতুন করে লিখতে হয় না আর। সেভ করে রাখা কপি এডিট করে নেওয়া যায় খুব সহজেই। তার পর তা চটজলদি পাঠিয়ে দেওয়া যায় নির্দিষ্ট জায়গায়। এর পরের পর্বে সম্পাদনা বা প্রকাশনার কাজেও নতুন করে টাইপ করার দরকার পড়ে না, প্রাপ্ত ওয়ার্ড ফাইলেই ছুরিকাঁচি চালানো যায়। সময় ও পরিশ্রমের বিস্তর সাশ্রয় হয়।
যা হারিয়ে যায়
এ সব সুবিধার পরেও কোথাও মনে হয়, সারাদিন কি-বোর্ড, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল স্ক্রিনের তীব্র আলোর চেয়ে পড়ার টেবিলের সাদা খাতার পাশে রাখা বেতের নকশা করা ল্যাম্পের কোমল আলোটা যেন অনেক বেশি ভাল ছিল! বেশি কাছের ছিল যেন হস্তশিল্প মেলা থেকে কেনা বিছানার পাশে রাখা পোড়া মাটির ল্যাম্পশেডটা, যার মৃদু আলোয় সদ্য মনে আসা ভাবনা শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিত সামনের খোলা সাদা পাতায়!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy