Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
খরচটাই কি আসল বিষয়?

শুধু কঠিন নয়, বিপজ্জনক এই ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ প্রস্তাব

অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশে যে এমন হয়, সেটা ঠিক। কিন্তু যে অর্থে পশ্চিমি গণতন্ত্র, পশ্চিমি সংবিধান, বা পশ্চিমি আইনের শাসন ইত্যাদি ভারতের পক্ষে ‘শিক্ষণীয়’, সেই একই ভাবে কি পশ্চিমি নির্বাচন পদ্ধতিও অনুকরণ করা উচিত?

একাগ্র: ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ বিষয়ে বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, ১৯ জুন। পিটিআই

একাগ্র: ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ বিষয়ে বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, ১৯ জুন। পিটিআই

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্পিতপ্রাণ সমর্থকদের বলতে শুনছি, ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জেতার সম্ভাবনা সাতানব্বই শতাংশের কম কিছুতেই নয়। সমাজমাধ্যমে কান পাতলেই ভেসে আসছে রাজ্যে আসন্ন বিজেপি শাসনের জল্পনাকল্পনা। কিন্তু, আসল কথা সেটা নয়। আসল কথা, এই যে পশ্চিমবঙ্গে এখনও তিন শতাংশ মতো পড়ে থাকছে অনিশ্চিতির বাক্সে, সেটুকুও কী ভাবে নিজেদের দিকে টেনে আনা যায়, বিজেপির উপরিতলে সেটাই এখন অহোরাত্র ভাবার বিষয়। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের আগে পুরোদস্তুর নিশ্চিত বন্দোবস্ত করতে হবে। একটা উপায়ও ঠাহরে ফেলেছেন নেতারা, যার নাম: ‘ওয়ান নেশন ওয়ান ভোট’। তাঁরা ধরে নিচ্ছেন, যে দুর্দান্ত প্রচারে এ বারের ভোটতরণি তাঁরা নিজেদের তীরে ঠেলে তুললেন, তেমন প্রচার দিয়ে একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা মিলিয়ে গোটা দেশ প্লাবিত করে ফেলতে পারবেন অদূর ভবিষ্যতেই, যদি তাঁরা সাথি পান ‘এক দেশ এক নির্বাচন’-এর নীতিটিকে। লোকসভার ঢেউয়ে বিধানসভাগুলি ভেসে যাবে, এমনটাই ভেবে নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কিনা, সাংসদ ও বিধায়ক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেটুকু যা বৈচিত্রের সম্ভাবনা ছিল, বুলডোজ়ারের তলায় তাকে প্রায় নিশ্চিত ভাবে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে ‘ওয়ান নেশন ওয়ান ভোট’ প্রক্রিয়াটি, এই হল শাসক দলের আশা। সম্পূর্ণ সঙ্গত এই আশা। দেশের যা পরিস্থিতি—এমন একটা সংস্কার ঘটলে তার থেকে লাভবান হতে পারে একটিমাত্র দলই। ভারতীয় জনতা পার্টি।

সুতরাং, গোড়াতেই বুঝে নেওয়া দরকার, দ্বিতীয় দফার মোদী সরকার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি ঝুলি থেকে টেনে বার করে হইচই-এর কারণ, ‘আসমুদ্রকাশ্মীর বিজেপি’-তে পৌঁছনো। ঠিক এই কারণেই প্রথম মাসের মধ্যে তড়িঘড়ি ঘটে গেল ‘সর্বদলীয়’ বৈঠক (যে বৈঠকে বিরোধী দলগুলি উপস্থিত ছিল না বললেই চলে), ঘোষণা হল একটি কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরির কথা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি নিজ মুখে জানিয়ে দিলেন, ভারতের থমকে-থাকা উন্নয়ন ও প্রগতির সমাধান এই সংস্কারের মধ্যেই!

অন্যান্য দল যেখানে অনুৎসাহী, সেখানে রাষ্ট্রপতির পক্ষে সমস্ত সাংসদের কাছে এই সংস্কার দ্রুত করে ফেলার আবেদন জানানোটা খুবই দৃষ্টিকটু। তবে দৃষ্টিকটু ঘটনা আজকাল এত অহরহ ঘটছে যে, আমাদের দৃষ্টিকেই সইয়ে নেওয়া ভাল। প্রসঙ্গত, এই সংস্কারটি কিন্তু বিজেপিরই ‘ব্রেনচাইল্ড’, কেননা এই দাবি প্রথম শোনা গিয়েছিল লালকৃষ্ণ আডবাণীর মুখে। ১৯৯৫ সালে তিনিই প্রথম বলেছিলেন— লোকসভার সঙ্গে রাজ্যের বিধানসভাগুলির ভোট করা যায় না বলে এ দেশের গণতন্ত্রও দুর্বল হয়, প্রশাসনের কাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১০ সালে বিজেপির সংসদীয় দলনেতা হিসেবেও তিনি এ কথা বলেন। সঙ্গে জুড়ে দেন একটা মন্তব্য: তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, দুই জনেই এই বিষয়ে আগ্রহী! তার পর এল ২০১৪। একটি পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটি রিপোর্ট ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জানিয়ে দিল, খুবই দরকারি এই ভাবনা। ‘নীতি আয়োগ’-এ ২০১৬ সালে ‘ডিসকাশন পেপার’-এ একই যুক্তি দিলেন বিবেক দেবরায় এবং কিশোর দেশাই। এর পর শোনা গেল ২১তম ল’ কমিশনের প্রস্তাব— সেই একই বক্তব্য। এই সংস্কার সম্ভব হলে, পাঁচ বছর পর পর লোকসভা ভোটের সঙ্গে বিধানসভাগুলিরও নির্বাচন করা গেলে— ‘অধিকাংশ ইউরোপীয় গণতন্ত্রে’ যেমনটা হয়— দেশের অশেষ মঙ্গল হবে।

অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশে যে এমন হয়, সেটা ঠিক। কিন্তু যে অর্থে পশ্চিমি গণতন্ত্র, পশ্চিমি সংবিধান, বা পশ্চিমি আইনের শাসন ইত্যাদি ভারতের পক্ষে ‘শিক্ষণীয়’, সেই একই ভাবে কি পশ্চিমি নির্বাচন পদ্ধতিও অনুকরণ করা উচিত? জোর দিয়ে বলা দরকার— না। ‘অধিকাংশ ইউরোপীয় গণতন্ত্র’-এর দেশগুলি আকারে এত ছোট, এবং প্রকারে এত সমতাবিশিষ্ট, যে নির্বাচনী পদ্ধতির ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে তাদের কোনও তুলনাই চলে না। যে যুক্তিতে এত বড় দেশে এমনকি লোকসভা ভোটকেই সাত দফা ধরে করতে হয়, ঠিক একই যুক্তিতে একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট করা এ দেশে অসম্ভব কঠিন হওয়ার কথা।

কেবল কঠিন নয়। অত্যন্ত বিপজ্জনক এই ভাবনা। এত বড় দেশের স্থানীয় ভোট স্থানীয় বিবেচনায় হবে, কেন্দ্রীয় শাসকদের নির্বাচন করতে অন্য এক ধরনের বিবেচনা লাগবে— এই মৌলিক নীতিটি ধরে নেওয়া হয়েছিল বলেই এ দেশে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় শাসনের স্তরটা আলাদা রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে কেবল সুবিধার বিবেচনা ছিল না, একটা আদর্শের ছায়াও ছিল। সেই আদর্শ অনুযায়ী, এ দেশ যেমন একটি কেন্দ্রীয় শাসনের দ্বারা এক সুতোয় বাঁধা, তেমনই এর প্রদেশ ও অঞ্চলগুলির নিজস্ব সত্তা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিবেচনা নিজ নিজ রকমের বলে সেই জায়গাটায় বৈচিত্র রক্ষা করাটাই উচিত ও বাঞ্ছনীয়। ঠিক এই কারণে এ দেশে সব প্রদেশের ভাষার নিজস্ব স্বীকৃতি আছে, কোনও জাতীয় ভাষার অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই (না, হিন্দি ভারতের ‘জাতীয় ভাষা’ নয়)। ঐক্য ও বৈচিত্রের পারস্পরিক বোঝাপড়াতেই এই দেশের জীবন এ্যাদ্দিন চলে এসেছে। প্রথম দিকে চূড়ান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় একসঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের ভোট করতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার মানে সেটাই করা ভাল— এমন ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। বলা হচ্ছে এই সংস্কার হলে নির্বাচনের খরচ এক ধাক্কায় অনেক কমে যাবে। সেটা অংশত ঠিক। অংশতই, কেননা একসঙ্গে এতগুলো রাজ্য ও কেন্দ্রের জন্য ইভিএম মেশিন বসানোরও বিরাট খরচ আছে বইকি। কিন্তু খরচটাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। বাস্তবিক, প্রথম প্রশ্ন হল, কেন এই সংস্কার। ১৯৬৭ সালের পর যে কখনও একসঙ্গে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক ভোট হয়নি, তাতে তো দেশের বড় কোনও ক্ষতি হয়নি। সুতরাং কেন্দ্রীকরণ ছাড়া এই সংস্কারের অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।— আসল কথা এটাই। অথচ, ভারতীয় সংবিধানের মূল সুরটি কিন্তু অত্যধিক কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে। ফলি নরিম্যানের মতো অভিজ্ঞ বিচারপতিদের মতে, মোদী সরকার নানা দিক থেকে, নানা পথে কেবলই দেশজোড়া কেন্দ্রীকরণের দিকে এগোতে চাইছে। অর্থাৎ সংবিধান যেখানে বলে, ভারত হল ‘আ গ্রুপ অব স্টেটস’, ওঁদের লক্ষ্য, দেশের যাবতীয় বৈচিত্র বিনাশ করে তাকে ‘আ গ্রুপ অব প্রভিন্সেস’ বানানো।

স্বভাবতই, সংবিধানেও বড়সড় পরিবর্তন দরকার এই সংস্কার করতে গেলে। এ দেশের সংবিধানে ‘নো কনফিডেন্স ভোট’-এর কথা আছে। কেন্দ্র বা রাজ্যের চালু সরকারকে অকেজো করে দেওয়া যায় এই ‘নো কনফিডেন্স’ মোশন দিয়ে। বহু বার এমন ঘটেছে। ১৯৯৯ সালে জয়ললিতার দল এআইএডিএমকে সমর্থন সরিয়ে নেওয়ার পর ‘নো কনফিডেন্স’ প্রস্তাব আনায় বাজপেয়ী সরকার পড়ে গিয়েছিল। ছয় মাস পর আবার ভোট হলে বিজেপি-নেতৃত্বে এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসে। আজ যদি একসঙ্গে এক সূত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের ভোট গাঁথতে হয়, তা হলে কিন্তু এই পদ্ধতিটাকে পুরোপুরি তুলে দিতে হবে। নয়তো ‘নো কনফিডেন্স’-এ সরকার পড়ে গেলে রাষ্ট্রপতির শাসন চালু করে দিতে হবে— গণতন্ত্রে যেটা একেবারেই অবাঞ্ছিত। এত বড় ধরনের সংবিধান সংশোধনী এনে এমন একটা সংস্কার তাই কোনও মতেই সমর্থনীয় নয়।

আসলে, ওয়ান নেশন ওয়ান ভোট-এর বিরুদ্ধে আপত্তিটা এই গণতন্ত্রের ভাবনার মধ্যেই লুকিয়ে। রাষ্ট্রপতির শাসন চাপানোর সম্ভাবনা এতে বাড়বে তো বটেই। তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী এর ফলে প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতিতে শাসিত দেশের প্রেসিডেন্টের মতো বিপুল ক্ষমতাধারী হয়ে উঠবেন। মোদীতন্ত্রের মনের গভীরে হয়তো এই বাসনাই লুকিয়ে। তবে আর বাকি সংবিধানটাকে রেখে কাজ কী। পুরোটাকে এক বারে খারিজ করে দিলেই হয়।

‘সর্বদলীয় বৈঠক’-এ একদলীয় প্রস্তাব পেশ হল, ঘোষণাও হল। বাকিটা? গণতন্ত্রের দেশের জনগণ-মনের উপরেই নির্ভর করা যাক।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy