ইতিহাস-রঞ্জিত: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উদ্যাপন উৎসব, কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, ১৭ অক্টোবর। পিটিআই
এক দল মজুরের মিছিলকে লাল নিশান হাতে এগিয়ে আসতে দেখে ধর্মতলায় দাঁড় করিয়ে রাখা লেনিন নাকি বলে ওঠেন, একটু পা চালিয়ে ভাই! শতাব্দী যে ফুরিয়ে এল!
সে না-হয় কবির কল্পনা। তবে বাস্তবিকই লাল ঝান্ডা নিয়ে পথ চলা এক শতক পেরিয়ে এল। লেনিনের দেশে বিপ্লবের কয়েক বছরের মধ্যেই তাসখন্দে বসে যে সলতে পাকানো, তাকেই এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের পথ চলার সূচনা বলে মানে। প্রতিষ্ঠা নিয়েও অবশ্য দ্বিমত আছে। তাসখন্দে ১৯২০ সালের উদ্যোগকে সিপিএম তাদের ভিত হিসেবে ধরলেও আদি সিপিআই আবার ১৯২৫ সালে কানপুরে দেশীয় উদ্যোগকেই পার্টি প্রতিষ্ঠার ফলক মনে করে।
বিতর্ক যা-ই থাক, এই শতবর্ষের উদ্যাপন শুরু হচ্ছে এমন সময়ে, যখন দেশের সংসদে বামপন্থীরা একেবারে ক্ষীণকণ্ঠ। এই বাংলা থেকে সংসদের দুই কক্ষেই কোনও বাম প্রতিনিধি নেই, স্বাধীনতার পর যা কখনও হয়নি। গত লোকসভা নির্বাচনে বামেদের ভোট রাজ্যে নেমে এসেছে ৭ শতাংশে। এক দিকে বিজেপি নেতাদের গর্বিত আস্ফালন শোনা যাচ্ছে, কমিউনিস্টরা অবলুপ্ত! আবার অন্য দিকে তৃণমূল নেতৃত্বের কণ্ঠে সহসা আক্ষেপের সুর, বামপন্থীরা কিনা বিজেপির হাতে তাদের সাজানো বাগান তুলে দিল!
বর্তমানে আসার আগে একটু অতীত-চর্চা সেরে নেওয়া যেতে পারে। কমিউনিস্ট পার্টির সুদীর্ঘ ইতিহাসকে ভেঙে নিলে তিনটি নির্দিষ্ট ও প্রধান অধ্যায়ের কথা বলতে হয়। প্রথমত, গোড়ার দিকে জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট ও সমাজবাদী ধারা হিসেবে থেকে এবং তার পরে পৃথক ভাবেই স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাদের অংশগ্রহণ। দ্বিতীয়ত, দলের রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণের প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যের জেরে পার্টি ভাগ এবং পৃথক দল হিসেবে ১৯৬৪ সালে সিপিএমের আত্মপ্রকাশ। তৃতীয়ত, দলের মধ্যে তাত্ত্বিক বাধা ও দার্শনিক প্রশ্ন নিয়েও সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ এবং সেই সুবাদে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে ওঠা।
তবে এ সবই কেতাবি ইতিহাস। কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস আসলে ধরা আছে তার আন্দোলনে, কারখানায় মজদুরের শ্রমে, মাঠে কৃষকের ঘামে। তেভাগা থেকে খাদ্য আন্দোলন— এই গোটা পথে কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার অবস্থানকে মোকাবিলা করে চলতে হয়েছে নানা ‘ভুল ধারণা’র। মেরঠ ষড়যন্ত্র মামলায় ব্রিটিশের হাতে অভিযুক্ত মুজফ্ফর আহমেদ (কাকাবাবু) কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বরাজের কথা বলেছেন, ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে ভগৎ সিংহ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান (ওই শব্দবন্ধ মৌলানা হসরত মোহানির অবদান) দিয়েছেন, চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বহু সেনানী কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষা নিয়েছেন, দ্বীপান্তর থেকে বেঁচে ফিরে স্বাধীন ভারতে পার্টির সদস্যপদও নিয়েছেন। আবার ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগানেরও নির্দিষ্ট কারণ ছিল। সেই স্লোগানের তাৎপর্য না খুঁজেই যাঁরা ‘দেশ-বিরোধী’ বলে কমিউনিস্টদের দাগিয়ে দিতে চান, তাঁরা সম্ভবত ভাবেননি, এক দিন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কাছে ‘দেশপ্রেম’-এর পাঠ নিতে হবে। নেতাজি বা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রাথমিক কমিউনিস্ট মূল্যায়নের কারণও খোঁজা যেতে পারে। গাঁধী খুন হওয়ার পরে তারা প্রতিবাদ করেনি— এ কথাও উঠেছিল বইকি। অথচ সে সময়ের পার্টি কাগজ অন্য কথা বলে। জনমানসে তৈরি ধারণার চাপে কিছু ক্ষেত্রে উত্তর প্রজন্মের কমিউনিস্ট নেতারা পূর্বসূরিদের গৃহীত অবস্থান সংশোধন করে নিয়েছেন, আবার কিছু ক্ষেত্রে জনসাধারণই ধারণার মোড়ক খুলে দিয়েছেন।
আজ অমিত শাহ বলেন, ‘‘কংগ্রেস একটা মঞ্চের মতো, যেখানে নানা ধরনের লোক আছেন। কিন্তু আমাদের যেমন আদর্শ আছে, তেমনই নিজেদের আদর্শ নিয়ে লড়াই করার শক্তি বলতে আছেন কমিউনিস্টরা। কিন্তু তাঁরা বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে আজ অপ্রাসঙ্গিক।’’ অর্থাৎ আদর্শগত প্রতিপক্ষ এই ভাবেই চিহ্নিত করছেন বিজেপির শাহেনশাহ।
জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করে সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ যে দিন উপত্যকা থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করছেন, সে দিনটা ছিল ‘কাকাবাবু’র জন্মদিন। তাঁর জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানের আগেই সে-দিন কলকাতার রাস্তায় কাশ্মীর-সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পথে নেমে পড়ে সিপিএম। দেশের বিরোধী শক্তি যখন এই প্রশ্নে হতচকিত, বিভ্রান্ত— বামেদের প্রথম প্রতিবাদ শোনা যায়। পরে তাদের সঙ্গী হয় ডিএমকে। কাশ্মীরের নেতাদের যখন বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে, শত দাবি ও আর্জিতেও কাজ হচ্ছে না, এই সময় সুপ্রিম কোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা করে দলের বিধায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ ইউসুফ তারিগামির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার অনুমতি আদায় করে আনেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। এই দলের প্রাসঙ্গিকতা এখনও আছে কি না, এই সব তথ্যই তা বলবে।
প্রশ্ন উঠবে, নিজেদের শক্তির কতটা সদ্ব্যবহার এঁরা করতে পেরেছেন? উত্তর সহজ— পারেননি! সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির চূড়ায় বসে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা যে বলেন ‘আমাদের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে দুর্নীতিগ্রস্তরা’, এই পরিস্থিতির নৈতিক দায় কমিউনিস্টদের নিতেই হবে। তাদের আদর্শের ক্ষয় না হলে, ভুল কৌশল ও অকারণ বিভ্রান্তিতে নিজেদের পথ রুদ্ধ করে না ফেললে এক দিকে সাম্প্রদায়িক, অন্য দিকে দুর্নীতিগ্রস্ত আঞ্চলিক শক্তির বেড়াজালে দেশকে আবদ্ধ হতে হত না।
তবে কিনা, শত সমালোচনার পরেও যে কথা মানতে হবে, এই দলের সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার নজির অম্লান। গাঁধীবাদী এবং কমিউনিস্ট, এই দুই আদর্শের মধ্যে বিরোধ থেকেছে। সংঘর্ষও বেধেছে। কিন্তু তাদের মাঝে কখনও সাম্প্রদায়িকতা বিষ সঞ্চার করেনি। বাংলার দিকে তাকালে সে কথা পরিষ্কার বোঝা যায়। রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী দেখতে দেখতে রাজ্যের মানুষের একাংশ হয়তো বুঝতে পারেন, টানা ৩৪ বছরের বাম শাসনে নানা অন্যায়, ক্ষমতার মোহ, ঔদ্ধত্যের ব্যাধি থাকলেও তফাত নিশ্চয়ই কোথাও একটা ছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছিল না, দুর্নীতির দায়ে কোনও প্রথম সারির নেতা-মন্ত্রীর গ্রেফতারের নজির ছিল না। ক্ষমতা হারানোর পরে আট বছরেও নেই।
শিয়রে এসে বসা বিপদের নীচেই এখন পুজো-মণ্ডপে বাম বইবিপণিতে রেকর্ড বই বিক্রি হয়। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) চালু করার বিজেপি-হুমকির বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় বামেদের মিছিল-সমাবেশে ভিড় চোখে পড়ে। ভোটার তথ্য যাচাইয়ের কাজে সহায়তার জন্য বামেরা সহায়তা শিবির খুললে লাইন দেন মানুষ। এনআরসি কী ও কেন, এই গোটা ‘অভিসন্ধি’ বুঝিয়ে বামেদের তৈরি পুস্তিকা হাত বাড়িয়ে কিনে নেন আতঙ্কিত বঙ্গবাসী।
অনেকেই মনে করেন, এনআরসি-ভীত মানুষ নিরাপত্তার খোঁজে দিশেহারা হয়ে বামেদের কথা ভাববেন না। অর্থাৎ বাম ভোট ৭% থেকে বেড়ে ১৭% হবে— এই ভাবনাই এখন অনুপস্থিত। প্রসঙ্গত, এ দেশে এমন সময় ছিল যখন মানুষ বামপন্থীদের ভোট দিতেন না, কিন্তু সম্মান দিতেন, সমীহ করতেন, বন্ধু ভাবতেন। ভোটের অঙ্কেই শুধু মন দিতে গিয়ে সেই সম্মান, শ্রদ্ধা জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছিল। বামেদের সামনে আবার সুযোগ এসেছে, মানুষের বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার। যে উদ্বাস্তু কলোনি বছরের পর বছর লাল পতাকার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে, সেখানে অধুনা গেরুয়া অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়েছে— চাকা ঘোরানো যাবে কি না, তা বামেদের উপরই নির্ভর করছে। পুজোর সময়ে টিভি চ্যানেল জুড়ে যখন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের নাচ, উল্লাস, কার্নিভাল, সেই সময়েই মহানন্দা-ফুলহারের তোড়ে বানভাসি মানুষের কাছে কিছু বাম নেতা-কর্মীর ত্রাণ নিয়ে পৌঁছে যাওয়া ঈষৎ প্রত্যয় জাগায়।
কিন্তু থেকে যায় আরও একটা কথা। গরিব মানুষের পার্টি থেকে মধ্যবিত্তের আপসপন্থী পার্টি হয়ে যাওয়ার পরে চাকা কি আবার ঘোরানো সম্ভব? এনআরসি, সাম্প্রদায়িকতা বা অর্থনৈতিক পীড়নের বিরুদ্ধে ভালমানুষের মতো চারটি বিবৃতি দিয়ে, লৌহপর্দার আড়ালে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমলাতন্ত্র বজায় রেখে কত দূর যাওয়া সম্ভব? মানুষে
মানুষে ভাগ করার রাজনীতির বিরুদ্ধে জোট তো বাঁধা চাই। সেই হিম্মত দেখাতে পারবেন শতাব্দী-পেরোনো কমরেডরা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy