শিক্ষাব্রতী: বাড়িতে অলিভ লেনন। নিজস্ব চিত্র
একদল খুদে বই খুলে বসে রয়েছে। সামনে এক নবতিপর ভদ্রমহিলা। মুখোমুখি বসে থাকা বছর সাতেকের খুদেরাও তাঁকে ‘আন্টি’ বলে সম্বোধন করছে। স্নেহ ভরা স্বরে তাদের ইংরেজি শেখাচ্ছেন তিনি। নবতিপর অলিভ লেনন। চলতি মাসেই যিনি ৯৪ বছরে পা দিয়েছেন। খড়্গপুরের গোপালনগরের বাসিন্দা অলিভ অবশ্য নিজের পেশা থেকে এখনও অবসর নেননি। ব্রিটিশ ভারতে শুরু করেছিলেন শিক্ষকতার পেশা। সেই কারণেই খড়্গপুরে আসা। খড়্গপুরেই বিয়ে। দীর্ঘ বছর চাকরির পরে অবসর নেন। কিন্তু ছাড়তে পারেননি পড়ানো। আবার স্কুলে যোগদান। তার পর অবসর। এখন বাড়িতেই ইংরেজি মাধ্যমের একদল প্রাথমিকের পড়ুয়াকে টিউশন পড়ান।
অলিভ মানে জলপাই। গাঢ় সবুজ। শিক্ষাব্রতী এমন সজীব ব্যক্তিত্বই তো সম্মানের অধিকারী। অলিভ পেয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সেলেন্স’। ঘটনাচক্রে সেদিনই ছিল তাঁর জন্মদিন। অলিভের শিক্ষাদানের ব্রতই এখন চর্চার বিষয়।
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের মেয়ে অলিভ। জন্ম ১৯২৫ সালে, কর্নাটকের হুবলিতে। বাবা জে ই পিটার্স ছিলেন রেল কর্মী। বদলির চাকরি। অলিভের তখন ৫-৬ বছর বয়স। তাঁদের চলে যেতে হয় তামিলনাডুর পেরাম্বুরে। সেখানে সেন্ট জোসেফ স্কুলে পড়াশোনা। দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করার পরে বাবা আবার বদলি। এবার চেন্নাইয়ে। প্রথাগত শিক্ষায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। কিন্তু শিক্ষক হওয়ার অদম্য ইচ্ছা ছিল। তাই চেন্নাইয়ে একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। তার পরেই আবেদন করেন বেঙ্গল-নাগপুর রেলের স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায়। ১৯৪৪ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে খড়্গপুর রেলের ইউরোপিয়ান স্কুলে (এখন মিক্সড স্কুল) চাকরি পান। একাই খড়্গপুরে চলে এসেছিলেন অলিভ। রেলশহরে বাস হয়ে গিয়েছে চার বছর। পড়ানোও। এমন সময়ে দেখা হয়ে গেল জে আর লেননের সঙ্গে। রেলের লোকো বিভাগে কর্মরত তরুণ। অলিভ তখন তেইশে। দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। বিয়ের জন্য দুই পরিবারের কথা পাকা হল। রেলের চাকরি ছেড়ে চেন্নাইয়ে পরিবারের কাছে ফিরে গেলেন অলিভ। ১৯৪৯ সালে বিয়ে করে ফের খড়্গপুরে আসেন। স্মৃতিচারণ করছিলেন, “বিয়ের জন্য চেন্নাইয়ে বাবা-মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু শিক্ষিকার চাকরি ছেড়ে ভাল লাগছিল না। বিয়ে করে খড়্গপুরে ফিরে এসেও শিক্ষিকা হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম।”
চেষ্টার ফল শিক্ষিকা জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। ১৯৫৪ সালে শহরের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের তৎপরতায় ঝাপেটাপুরে বেসরকারি কনভেন্ট স্কুল চালুর উদ্যোগ শুরু হয়। অলিভ বলেন, “আমিও ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। যদিও কয়েক বছর আগে থেকেই ওই স্কুল কখনও চার্চে, কখনও কারও বাড়িতে চলত। কিন্তু ১৯৫৪ সালে পাকাপাকি ভাবে ঝাপেটাপুর স্কুল চালু হল। আমিও শিক্ষিকা পদে যোগ দিলাম।” মূলত প্রাথমিকের ইংরেজি শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এই স্কুলেই টানা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ৬৫ বছর বয়সে অবসর। ১৯৭৫ সালে রেলের শপ সুপারিন্টেনডেন্ট পদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। বাড়িতেই সময় কাটছিল দুই অবসরপ্রাপ্ত দম্পতির। কিন্তু পড়ানোর নেশা যে প্রবল। চাকরি খুঁজছিলেন অলিভ। ২০০০ সালে সেন্ট অ্যাগনেস স্কুলের পাশেই সেক্রেড হার্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন তিনি। অলিভের কথায়, “আসলে ১৯ বছর বয়স থেকে পড়ানোর যে ঝোঁক বেড়েছিল অবসরের পরে তা কমেনি। বরং বেড়ে গিয়েছিল। তাই সেক্রেড হার্টে অধ্যক্ষের পদে যোগ দিয়েছিলাম। ২০০৩ সালে ওই পদ থেকেও অবসর নিই। কিন্তু শিক্ষকতার পেশা ছাড়তে পারিনি। বাড়িতে টিউশন পড়াতাম।” স্বামীর চাকরি সূত্রে প্রথমে সাউথ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন রেল কোয়ার্টারে থাকতেন। স্বামী অবসর নেওয়ার পরে ঝাপেটাপুর-ছোটট্যাংরা এলাকাতেই ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। নিজের বাড়ি হয়নি। ২০০৬ সাল থেকে গোপালনগরে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন। ২০০৮ সালে ওই বাড়িতেই স্বামীর মৃত্যু হয়।
লেনন দম্পতি নিঃসন্তান। তাঁর নিঃসঙ্গ জীবন ভরিয়ে রাখে পড়তে আসা খুদেরাই। বয়স বেড়েছে। সমস্যা বেড়েছে। ভুগছেন হাঁফানিতে। কিন্তু শারীরিক সমস্যা বাধা হয়নি টিউশনে। গত বছর কয়েকদিন অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু একটু সুস্থ হতেই শুরু করেছেন পড়ানো। অলিভ জানান, তাঁর আত্মীয়দের সকলেই বিদেশে থাকেন। নিজের বলতে ভাইপো রবার্ট, তাঁর স্ত্রী মেরি ও তাঁদের খুদে সন্তান আলফ্রেড। তাঁরাই এখন অলিভের দেখভাল করেন। যোগাযোগ রয়েছে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশনের সঙ্গে। সংস্থার সহযোগিতাতেই অলিভের ৯৪ বছর বয়সেও শিক্ষকতার কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা প্রকাশ্যে এসেছে। পত্রিকা গোষ্ঠীর সম্মান পেয়ে আপ্লুত অলিভ। বললেন, “আগে তেমন কোনও অ্যাওয়ার্ড পাইনি। এ বার পেলাম। আর ওই দিনই কাকতালীয়ভাবে আমার জন্মদিন ছিল। এটা অবশ্যই আমার কাছে স্মরণীয় ও আনন্দের।”
দীর্ঘজীবন অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী। দেখেছেন শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন। আর সেটা কালের নিয়মেই! তা বুঝতে পারেন অলিভ। তাই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাদান চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি, “আমার মনে হয় আগে পড়ানো অনেক সহজ ছিল। অধিকাংশ পড়ুয়া ইংরেজি জানত। এমনকি শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে পড়ুয়াদের সকলের মাতৃভাষা ছিল ইংরেজি। কিন্তু এখন অন্য মাতৃভাষার পড়ুয়াদের পড়াতে হয়। তাই ইংরেজি শেখানো কিছুটা কঠিন। তবে আমি পড়ুয়াদের সঙ্গে সবসময়ে ইংরেজিতেই কথা বলি। এটা খুব দরকার।” অলিভের মাতৃভাষা ইংরেজি হলেও আগে তামিল জানতেন। চর্চার অভাবে তামিল ভাষা ভুলে গিয়েছেন। এখন শুধু ইংরেজিতেই কথা বলতে পারেন। তাঁর কথায়, “আগে তো কোনও অসুবিধা হত না। কিন্তু এখন দেখি এখানে অধিকাংশ পড়শি হিন্দি বা বাংলায় কথা বলেন। তবে তাঁরা আমাকে মানিয়ে নিয়েছেন।”
সমাজ সচেতন অলিভ। দীর্ঘ সময় ধরে নানা বদল তাই ধরা পড়ে তাঁর চোখে-বোধে। একটা তুলনামূলক ছবির কথা তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন। বলেন, “ভারতের স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালের সঙ্গে উন্নতিতে একটা বড় পার্থক্য দেখি। প্রায় ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ রেল অফিসারেরা যেহেতু ছিলেন তাই রেলের এলাকা অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু এখন তো অনেক অপরিচ্ছন্ন চেহারা দেখি। তবে রেল এলাকার বাইরে শহরের পুরসভা এলাকায় পরিকাঠামো উন্নতি হচ্ছে।” শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে বলে তিনিও মনে করেন। নবতিপর শিক্ষিকার কথায়, “আগের তুলনায় এখন বই অনেক উন্নত। শিক্ষিকাদের তাই আরও বেশি যুগপোযোগী হতে হবে। পড়ুয়াদের প্রতিযোগিতাও অনেক বেড়েছে।”
শিক্ষাদানের প্রতি দায়বদ্ধ তিনি। কিন্তু শৈশব চিরসবুজ থাকে খেলাধুলোতে। মনে করেন অলিভ। চিরসবুজ জলপাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy