Advertisement
E-Paper

পুরনো রাজনীতি পরিমিতিবোধ হারিয়েছে, জন্ম নিচ্ছে নতুন স্রোত

আজকের কঠিন সময়ে ছাত্র যুব সমাজ প্রতিবাদের এক নতুন ইতিহাস রচনা করছে। নিদারুণ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন আজ দিশাহীনতায় ভুগছে।

দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share
Save

একটা সহজ প্রশ্ন করেছিলেন ঐশী ঘোষ। আচ্ছা, এই রাজ্যের প্রশাসন তো দিল্লির চাপিয়ে দেওয়া সিএএ বা এনআরসি-র বিরোধী, তা হলে আমরা বিরোধিতা করলে তা পুলিশ দিয়ে রুখে দেওয়া হচ্ছে কেন? প্রশ্নটা সহজ, উত্তরটা নয়। রাজ্য প্রশাসনের সর্বময়ী কর্ত্রী প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আক্রমণাত্মক। মনে করিয়ে দিয়েছেন নব্বই দশকের গোড়ায় হাজরা মোড়ে তাঁর ‘নিজের মাথায় সিপিএমের লাঠি’ পড়ার ঘটনা। তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন সিপিএমের লাঠি থেকে বাঁচতেই বাংলার মানুষ তাঁকে রাজ্য প্রশাসনের কর্ণধার করেছেন।

সে যাক। কিন্তু, আজকের ঐশীদের প্রশ্নগুলো, ওঁদের রাজনৈতিক জীবনবোধ, আমরা কি বুঝে উঠতে পারছি? আমরা কি দেখতে পাচ্ছি যে, রাজনৈতিক দলের ঘেরাটোপের বাইরেও এক নতুন যুবকযুবতী পরিসর গড়ে উঠছে, যা সমাজ ও ক্ষমতার রসায়নে তৈরি চিরাচরিত শাসন ব্যবস্থা নিয়েই জোরদার প্রশ্ন তুলে দিয়েছে? এই প্রশ্ন থেকে উদ্ভূত হচ্ছে নতুন আন্দোলন, যে আন্দোলন থেকে গভীর দ্যোতনায় মুখরিত হচ্ছে আজাদির দাবি। এই আজাদি ক্ষমতাকে আর একমাত্রিক ভাবে দেখছে না। নির্বাচনে জিতে যেন তেন প্রকারেণ একটা সরকার তৈরিতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে না। এই আজাদি মুক্তি চাইছে জাতি বৈষম্য, পুরুষতন্ত্র, ধর্মীয় বিভেদ কিংবা শ্রেণি-আধিপত্যের নিগড় থেকে, প্রতিবাদের রস শুষে নিচ্ছে এই উপমহাদেশেরই চেতনাপুষ্ট জমি থেকে। রবীন্দ্রনাথ থেকে অম্বেডকর, বিরসা থেকে ফুলে, বিস্তৃত এক ইতিহাসের রামধনু আকাশ আজকের যুবক-যুবতীদের রাজনীতি চেতনায় নতুন আলোয় জেগে উঠছে। প্রতিবাদ নতুন ভাষা পাচ্ছে।

রাজধানী দিল্লিতে একটি সর্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুবাদে ঐশীদের মতো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার প্রতি দিন সাক্ষাৎ হয়। একটি কঠিন কঠোর ও সর্বৈব নির্মম প্রশাসনের চোখে চোখ রেখে কী অসীম সাহস আর নিপুণ কৌশলে লড়ে যেতে হয়, সে শিক্ষা এই ছাত্রছাত্রীদের থেকে বিশ্বের যে কেউ নিয়ে যেতে পারেন। এই লড়াইয়ে যেমন গৌরব আছে, তেমনই বিশ্বাসভঙ্গ আছে, বিভাজন আছে, অনিশ্চয়তাও আছে। দু’টি জিনিস নেই। ভয় ও নৈরাশ্য। কাজেই কোনও প্রশাসন যদি ভাবে যে হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী দলিত ছাত্রের মাসিক বৃত্তি বন্ধ করে দিলে, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভরত ছাত্রদের রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গেলে, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার গ্রন্থাগারে হাড়হিম করা পুলিশি সন্ত্রাস চালালে, জেএনইউয়ের ছাত্রী বা শিক্ষিকার মাথায় ডান্ডা মেরে ‘‘গোলি মারো শালোঁ কো’’ বলে চেঁচালে, বা এই রাজ্যের বুকে ছাত্র যুব প্রতিবাদে পুলিশি ব্যারিকেড তুলে আর চৌত্রিশ বছরের ‘অত্যাচার’-এর রেকর্ড বাজিয়ে এই জাগ্রত যুবাশক্তিকে রুখে দেওয়া যাবে, তা হলে বলতেই হয় ক্ষমতা তার পরিমিতিবোধ হারিয়ে ফেলেছে। যেমন হারিয়ে ফেলেছিল সত্তর দশকের মাঝামাঝি কেন্দ্রের কংগ্রেস, দশ বছর আগে রাজ্যের বাম সরকার, বা এই গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শাহিন বাগকে শক থেরাপি দিয়ে সবক শেখানোর কদর্য আহ্বান।

আজকের কঠিন সময়ে ছাত্র যুব সমাজ প্রতিবাদের এক নতুন ইতিহাস রচনা করছে। নিদারুণ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন আজ দিশাহীনতায় ভুগছে। দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ— অসংগঠিত শ্রমিক ও ছোট বড় কৃষক— আজ শুধু টিকে থাকার দৈনন্দিন লড়াইয়ে ক্লান্ত। মধ্যবিত্ত বহুকাল প্রতিরোধের ভাষা ভুলে পণ্যমোহে মশগুল। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি দেবে কোনও একটি রাজনৈতিক দল, এমন বিশ্বাস মানুষের আজ নেই। এমনকি কোনও প্রতিষ্ঠানই আজ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, সবই যেন প্রতারণার পীঠস্থান। এই দুর্দিনে এক ত্রাতা এলেন। সংবাদ ও সামাজিকমাধ্যম প্রবল ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে দিল ইনিই সর্বরোগের প্রতিষেধক, শত্রুর শেষ দেখে ছাড়বেন। তিনি সুকৌশলে বলে দিলেন শত্রু তোমার গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে। পোশাক দেখলেই তাকে চিনে ফেলা যায়। ঘুষপেটিয়া। আর শাস্ত্রে বলে, শত্রুর শেষ রাখতে নেই। দেশের বড় একটা অংশের মানুষ আজ এই স্রোতে ভাসমান।

এই হিংস্র আবর্ত থেকে বহির্গমনের যদি ক্ষীণ কোনও সম্ভাবনা থাকে, তবে তার কেন্দ্রে আছেন এই ছাত্র যুবারা, বা শাহিন বাগ-পার্ক সার্কাসে কোলে বাচ্চা নিয়ে রাতজাগা দাদি-বোনেরা। ওঁরা এক নতুন রাজনীতির স্রষ্টা। এই রাজনীতি বলে, তুমি আমার রক্ত ঝরালে আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করব। এই রাজনীতি বলে, তুমি নির্বাচনী প্রচারে আমাকে শত্রু দাগিয়ে দিলে, তোমার পরাজয়ের দিন আমি মৌনী থাকব। এই রাজনীতি বলে, তুমি বিষোদ্গারে শালীনতার মাত্রা ছাড়ালে আমি শুধু তোমাকে প্রশ্ন ছুড়ে দেব। এই রাজনীতি দলতন্ত্রে আবদ্ধ করলে এর মৃত্যু, এর সাবলীল বহুজন সত্তাই এর প্রাণের স্পন্দন। একটু মন দিয়ে কানহাইয়া, উমর, ঐশী, জিগ্নেশ বা চন্দ্রশেখর-এর কথা শুনুন। এঁদের বহু মতের সঙ্গে আপনার হয়তো মিল হবে না। কিন্তু খেয়াল করবেন, এঁরা যা বলছেন তা এঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ। হলুদ হয়ে যাওয়া কোনও পৃষ্ঠা থেকে মুখস্থ করা কেঠো শ্রেণিসংগ্রাম বা জাতিবৈষম্যের কথা এঁরা বলছেন না। এঁরা শ্রমিক, দলিত, সংখ্যালঘু সত্তার এক সম্মিলিত প্রতিরোধের ব্যাকরণ খোঁজার চেষ্টা করছেন, যা আবেগ ও যুক্তির ভারসাম্যে সাবেক হয়েও আধুনিক, সর্বজনীন হয়েও দেশজ। এঁরা ‘‘অমুকবাদ সর্বশক্তিমান কেননা ইহা সত্য’’ এমন তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। বরং এঁরা শক্তির মধ্যে মিথ্যে খুঁজে পেয়েছেন, আর সত্যের সন্ধান যে চিরায়ত, কোনও দেশি বা বিদেশি বেদবাক্যেই যে তা লিপিবদ্ধ নেই, এই জ্ঞান তাঁদের বচনে ইঙ্গিতে স্পষ্ট।

এই যুবসমাজ কিন্তু তার প্রাণভঙ্গিমায় নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে কসুর করেননি। প্রতিবাদের নতুন গান, নতুন ছবি, নতুন মিম, নতুন শব্দ সামাজিক মাধ্যমের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। বুদ্ধিগত, তার্কিক ও সংশয়াদীর্ণ। সে যেমন কাউকে দেশের গদ্দার ভাবতে প্রস্তুত নয়, শহিদ সভায় ‘পাগলু’ ছবির নাচ নাচতেও নয়। তাঁর পরিমিতিবোধই তাঁর পরিচিতি। এই পরিমিতি ওপর থেকে চাপানো কোনও শৃঙ্খলার জবরদস্তি নয়, এই পরিমিতি গভীর এক আত্মশক্তিতে সমৃদ্ধ। আজ যে নতুন বামপথ জন্ম নিচ্ছে আমাদের চোখের সামনে তা কোনও রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের ওজন কাঁধে নিতে রাজি নয়। এই বামপথ কর্মস্থান থেকে ধর্মস্থান, সর্বত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। এই বামপথ ডাক দেয় প্রসারিত ঐক্যের, এক বিকল্প সাম্যভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখে।

এই স্বপ্নের মনন উৎকর্ষে অচ্ছুত নন কোনও মানবিক চিন্তাবিদ, মার্ক্স থেকে গাঁধী, মায়াকভস্কি থেকে ফয়েজ, মনবিঁয়ো থেকে বহুগুণা, বিস্তৃত ক্ষেত্রের বর্ণালি দর্শনের ফসল তুলে আনতে চায় এই যুবযুবারা। কোনও দলীয় শাসনের খাঁচায়, বিশেষ করে বহুব্যবহৃত কোনও রাজনৈতিক বাঁধাবুলির ঘেরাটোপে চাপা পড়লে এই পথ তার সাহসী চলার ছন্দ হারাবে। আজ এই নৈরাশ্যের পৃথিবীতে আশার আলো দেখাচ্ছেন ঐশীরা। এই প্রথম দেখছি প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ থেকে আসা প্রান্তিক সমাজের ছাত্রছাত্রীরা জেএনইউ ক্যাম্পাসের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছেন রাজধানীর মহল্লায়-বস্তিতে। ভয়-পাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, স্লোগান তুলছেন পুলিশের আগ্রাসনের সামনে দাঁড়িয়ে। বলছেন, আমরা দেশ বাঁচাতে এসেছি, তুমিও সঙ্গে এসো। দিল্লির শৌখিন উচ্চকোটির বামপন্থা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তায় সাধারণের রক্তঘাম সংঘর্ষের থেকে নিরাপদ দূরত্বে নিজের বিদ্যাসন্ধানে মগ্ন থেকেছে, তা আজ জৌলুস হারিয়েছে। পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলিহেলনে যত ব্যারিকেড তুলেছে, দিল্লির এই বিষবাষ্প উপেক্ষা করে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ততই ছড়িয়ে পড়েছে জামিয়া নগরে, বাটলা হাউসে, ইন্ডিয়া গেটে, মান্ডি হাউসে। একই ঘটনার অনুরণন দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশে, বিহারে, বাংলায়।

কলকাতা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক বন্ধ রেখে কি আটকানো যাবে এই উদ্দীপনার আঁচ?

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি

Indian Politics JNU Aishe Ghosh Jadavpur University Presidency College

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।