নবনীতা দেবসেন। ফাইল ছবি
‘‘সব আলো ফিরে দাও, সব রঙ, সকল উত্তাপ/ আমি সব বেঁধে নিয়ে আরেক আকাশে যাবো আজ’’
সত্যিই সে দিন তিনি হাসতে হাসতে, মৃত্যুকে কাঁচকলা দেখিয়ে অন্য আকাশে ভ্রমণে গেলেন। বাহারি বেড়ানো নয়, তিনি তো ঝোলা কাঁধে তুলে বাউন্ডুলে ভ্রমণের এক ব্র্যান্ডই তৈরি করে ফেলেছেন। কবে? আজকের মেয়েরা যখন, ‘সোলো ট্রাভেলার’ লেবেল বুকে সাঁটছে তার বহুযুগ আগে। সেই আর এক আকাশে যাওয়ার তোড়জোড়ের সময় কিন্তু মনে হচ্ছিল, ছটফটে কৌতুকপ্রিয় মানুষটি কি অতক্ষণ ও ভাবে শুয়ে থাকতে পারেন? মঞ্চে এই রোল কিন্তু ‘নটি’ নবনীতার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। ক’দিন আগেই তো বুক ঠুকে, কর্কটভিলেনকে চ্যালেঞ্জ করে লিখেছেন, ‘জানিস আমি স্যান্ডো করি’। বেড়িয়ে ফিরে কলম ধরলে নিশ্চয়ই লিখতেন, ‘তোরা যে আমাকে ঘিরে আমার পছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি গাইলি, খুব ভাল লেগেছে রে...’
রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপির কারণে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম। ওঁকে তখন ছোঁয়া বারণ। কাছে গিয়ে প্রণাম করাও বারণ। ‘সই’-এর আসর বসেছে ‘ভালো-বাসা’য়। বাড়িতে সেই অনেক চেনা ঘরে। নবনীতাদি তাঁর সেই নিজের চেয়ারে। ‘সই’ নবনীতা দেবসেনের আর এক সন্তান। সৃষ্টিশীল মেয়েদের ডানা মেলার আকাশ। বেশ ডাগর হয়েছে সে। এ বছর তার একুশে পা। সে দিন সবাই নিজেদের মনকে বুঝিয়ে একটু দূরে থাকছি। হঠাৎ দিদি ঝট করে উঠে পাশের এক জনকে খপ করে ছুঁয়ে দিয়ে, অন্য দিকে, মুখ ফিরিয়ে সেই প্রসিদ্ধ বালিকাহাসি হাসতে শুরু করলেন! কে জানত সে দিনটিই নবনীতাদিকে ঘিরে শেষ ‘সই’ সমাবেশ। সে দিন ছিল সদ্য প্রয়াত টনি মরিসনের লেখা নিয়ে আলোচনা। দুনিয়া জুড়ে লক্ষ কোটি মানুষ নবনীতা দেবসেনের ভালবাসার বৃত্তে বাস করেন। সুদূর পেরুর ট্যাক্সি ড্রাইভার মিগুয়েল থেকে শুরু করে বেশ কয়েক জন নোবেল প্রাপক। তবু ওনার মনে থাকে কার সুগার, কার চিংড়ি মাছে অ্যালার্জি, কার কবে জন্মদিন। আর সেই অনুযায়ী তাঁর রাজেশ্বরী হাঁকডাক, ‘‘কানাই, আমার ওই বইটা আন, ওকে দেব। ঝর্ণা, ওর প্লেটে চিংড়ি দিয়েছ কেন, বদলে দাও।’’
কাঁকর, কাঁটা, পেরেক ,ভাঙা কাঁচ যা কিছু থাকুক পথে, নবনীতা-কাঠির ছোঁয়ায় সব অপরাজিতা ফুল হয়ে যায়। উনি যে ইচ্ছেপথ তৈরি করার জাদু জানেন। সে পথের ধারে অভিজাত অধ্যাপিকার খোলস ছেড়ে, কুম্ভমেলার সাধারণ তীর্থযাত্রীর তাঁবুতে ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপা যায়, ট্রাকে চড়ে ম্যাকমোহন লাইন ছুঁয়ে আসা যায়। আবার গদ্য, পদ্য আর অনুবাদ মিলিয়ে আশিখানা বইও লেখা যায়। বই লিখতে গিয়ে নিজেকে নিয়ে চূড়ান্ত ফাজলামি কে আর করতে পারে! সে বই পড়ে কারা? পাঠকের তালিকা করতে গেলে দুনিয়ার সব কাগজ ফুরিয়ে যাবে— মুদিখানার মালিক, স্কুলপড়ুয়া বালিকা, কাফেতে আড্ডা দেওয়া যুবক, ব্যস্ত গৃহবধূ, পৃথিবীর সব নামীদামি মানুষ। বাংলা অক্ষর চেনে যে, সেই পড়ে। মগ্ন হয়ে পড়ে। কারণ, অক্ষরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাঙালির বুদ্ধিমত্তা মেশানো আটপৌরে হাসি, মজা, মসকরা আর তার ভিতরে থাকে এক গভীর দর্শন। সহজ কথায় লঘু হাসি থেকে গম্ভীর বিষয়ে বিচরণ তাঁর যেন এ ঘর থেকে ও ঘরে যাওয়া আসা। কে কোন পরতের স্বাদ নেবে তা তাঁর নিজস্ব নির্বাচন। ঝাণ্ডা হাতে নারীবাদী মিছিলে তিনি হাঁটেন না, নিজের গায়ে ‘নারীবাদী লেখক’ তকমা আঁটাতেও আপত্তি। কিন্তু, মেয়েদের অধিকার আদায়ের পক্ষে, অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর প্রিয় টেম্পলপেড়ে মেরুন শাড়ির আঁচলের তলার প্রদীপটি মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। সে মশালের আলো ও আগুন ঝরে অক্ষরে। শুধু প্রতিবাদ নয়, অক্ষর দিয়ে তিনি শুশ্রুষা করেন, পথ দেখান। নারীবাদী মেয়ের বিয়ের পরে কান ফোটানোতে আপত্তি। উনি বললেন, ‘‘ওরে এত ছোটখাটো ব্যাপারে শক্তিক্ষয় করলে আসল স্বাধীনতার লড়াই করবি কি করে!’’ কন্যাকে বলা নবনীতা দেবসেনের এই অক্ষরগুলি যে মেয়েরা মাথায় রাখল, তাঁদের জীবনে তা যেন গুরুবচন হয়ে গেল। কিছু অর্থমূল্যে কেনা জিনিস খোয়া গেলে মনখারাপ? উনি বলেন, ‘‘ধুর, যা টাকা দিয়ে কেনা যায় তা নিয়ে মাথা খারাপ করে লাভ নেই।’’ এ ভাবে লেখার অক্ষরে নবনীতা দেবসেন এক অনন্ত পজিটিভিটি ছড়িয়ে চলেন, এক বহুমাত্রিক পজিটিভিটি।
‘ভালো-বাসা’ বাড়ির চিরকিশোরী চঞ্চল মেয়েটি বাংলা সাহিত্যে একে বারে নতুন যে সিগনেচার স্টাইল আনলেন তা আলোর মতো উল্লম্ব ভাবে, বাতাসের অক্সিজেনের মতো অনুভূমিক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে চরাচর জুড়ে। অধ্যাপিকা, কবি, লেখিকা, ভ্রামণিক, আরও কত বিচিত্র চরিত্র। ‘‘বহির্ভুবনে আমার যে ভূমিকা, তার সঙ্গে আমার অন্তর্লোকের ভূমিকাটির প্রায়ই যোগ থাকে না।’’ এ স্বীকারোক্তির প্রমাণ মেলে কবিতায়। গদ্যের হাসিখুশি নবনীতা পদ্যের ঘাটে এসে নিজেকে মেলে ধরেন কী এক শান্ত গম্ভীর প্রত্যয়ী নবনীতায়। সেখানে,
‘‘জলের অনেক নীচে খেলা করি, শর্তহীন, একা/ সেইখানে পৌঁছবে না খাজনালোভী সমাজ পেয়াদা/ জলের অনেক নীচে সৌজন্যের দুঃখ সুখ নেই’’
চলতি সময়টা নিয়ে ভাবছিলেন খুব। যদিও ‘সময়’ কে ডরানোর মানুষ তিনি নন, সেই কবে ১৯৭৩ সালে লেখা, ‘এইকাল-চিরকাল’ কবিতা অমর অক্ষয় অব্যয় হয়ে আছে। তবু, এ বার একটু বেশি ভাবছিলেন। সই মেলার বিষয় নির্বাচন করেছিলেন, ‘এই অবরুদ্ধ সময়ের কথা’।
কর্কট বনাম মানবীর লড়াই কি সমাপন? মোটেই না। ওহে কর্কট, খেলায় তুমি হেরো, তুমি হেরো ইচ্ছেমানবীর আসলে এক দ্বীপে বেড়াতে যেতে খুব ইচ্ছে করছিল। তাই, ‘আর খেলবো না তোর সঙ্গে’ বলে কলম নামিয়ে সেখানে গেলেন।
নবনীতাদি যতই বলুন, ‘‘সেই দ্বীপে কোনোদিন তোমাদের জাহাজ যাবে না’’। আমরা ভ্যানরিকশা, হাওয়া গাড়ি, যাতে পারি চেপে ঠিক এক দিন সেখানে পৌঁছে যাব। ‘ভালো-বাসা’ বাড়ির পুরনো বাঙালি প্রথা মেনে ছোট ছোট লুচি, সাদা আলুর তরকারি, মিষ্টি সাজানো প্লেট আসবে। কেল্টুস বা তাঁর অন্য কোনও পুষ্যিকে আদর করে, যেই আমরা লুচির দিকে হাত বাড়াব। তিনি খুব বকুনি দেবেন, ‘‘যাও, হাত ধুয়ে এসো...’’
দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy