মায়ের কোলে শিশু। ফাইল চিত্র
আমরা জানি, মা ও শিশুদের ক্ষেত্রে অপুষ্টিতে ভোগার সম্ভাবনা অত্যধিক। তারা অপুষ্টির শিকার হয়ও নানা ভাবে। মহিলা, গর্ভবতী মা ও দুগ্ধবতী মা, ছ’বছরের নীচে শিশুদের ক্ষেত্রে আশঙ্কা থেকেই যায়।
অপুষ্টির জন্য মূলত দায়ী পরিমাণমতো ও ঠিক গুণমানের সুষম খাদ্যের অভাব। এ ছাড়া, বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, টিকাকরণ এবং অন্য কিছু রোগ থেকে মুক্তি। অপুষ্টি নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, বাসস্থান বা পরিবেশের দরকার। তা কেবল আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল মানুষই জোগাতে পারেন। অর্থনৈতিক বা সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষজন পারেন না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বা অন্য সুবিধা মিললেও কেবল চিরাচরিত বিশ্বাস, প্রথা, সংস্কারের জন্য সে সব জিনিসের ব্যবহার হয় না। ফলে, বহু মহিলা ও শিশুকে অপুষ্টির শিকার হতে হয়।
আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু শিশুদের পুষ্টি সংক্রান্ত বিষয়। আমাদের ধারণা ছিল, কেবল কমবয়সি শিশু বা স্কুলে যাওয়া বাচ্চারাই অপুষ্টির শিকার হয়। কিন্তু তা ঠিক নয়। শিশু অপুষ্টির শিকার হচ্ছে তার গর্ভকালীন সময় থেকে। দুর্বল, কমবয়সি, রক্তাল্পতায় আক্রান্ত ৪০ কেজির কম ওজনের মায়েরা গর্ভাবস্থায় আরও বেশি অপুষ্টির শিকার হন। ফলে, গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়। আমাদের দেশে ২.৫ কেজির নীচের শিশুকে কম ওজনের নবজাতক বলা হয়। এই সব কম ওজনের শিশু যদি ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ ঠিকঠাক না পায় তা হলে সে আরও অপুষ্টির শিকার হয়। আবার অপুষ্টিতে ভোগার জন্য তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। ফলে, সহজেই তার রোগাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। বারবার রোগে ভোগার ফলে শিশুটি আবার বেশি অপুষ্ট হয়ে পড়ে। রোগ সংক্রমণ ও অপুষ্টি— এই দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে।
জন্মানোর পরেই নবজাতককে বুকের দুধ দেওয়া দরকার। মায়ের দুধ শিশুর পক্ষে আদর্শ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার। শুধু তা-ই নয়, প্রথম দিককার গাঢ় ঈষৎ হলুদ বর্ণের মায়ের দুধ যাকে ‘কলোস্ট্রাম’ বলা হয়, তা শিশুকে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। তাই কোনও শিশু জন্মানোর পরে তাকে ‘কলোস্ট্রাম’ থেকে বঞ্চিত করা মারাত্মক ভুল ও শিশু স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক। যদিও প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই গাঢ় পুরু দুধ বাচ্চার পক্ষে হজম করা সম্ভব নয় বলে অনেক সময় তাকে ‘কলোস্ট্রাম’ থেকে বঞ্চিত করা হয়। বদলে দেয়া হয় গ্লুকোজের জল, মধু, ছাগল বা ভেড়ার দুধ, তাল মিছরির জল। এ সব জিনিস পরিপাক করার মতো উৎসেচক তখনও বাচ্চার দেহে তৈরি হয় না। ফলে, এক দিকে যেমন বদহজম হতে পারে তার সঙ্গে খাদ্যে জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার এগুলো বেশি মিষ্টি বলে পরের দিকে তুলনায় কম মিষ্টি বুকের দুধ খেতে বাচ্চাটির অনীহা দেখা যায়। আশার কথা, বুকের দুধের আগেই এই নানা ধরনের পানীয় দেওয়ার প্রথা বর্তমানে কমেছে।
আবার বহুদিনের চলে আসা প্রথা বা বিশ্বাস অনুযায়ী, সদ্যপ্রসূতিকে সাত দিনের আগে ভিজে খাবার দেওয়া হয় না। বদলে খই, চিড়েভাজা, বিস্কুট ইত্যাদি শুকনো খাবার দেওয়া হয়। এমনকি, জলও পান করতে দেওয়া হয় না। ফলস্বরূপ, বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পর থেকেই মায়ের শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক সময় তাঁর দুধও শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ছ’মাস পর্যন্ত কেবল বুকের দুধ খাওয়ানো হলে, কম ওজনের শিশুরাও স্বাভাবিক ওজন লাভ করে এবং তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয় না। শিশুদের পুষ্টির ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় যখন বাচ্চার বয়স হয় পাঁচ থেকে ছ’মাস। বুকের দুধ খেয়ে থাকা শিশু এর পরে শুধু বুকের দুধে সম্পূর্ণ পুষ্টি পায় না। তখন থেকে তার দরকার নরম, সুস্বাদু, সহজপাচ্য পুষ্টিকর খাবার। এই খাবার আয়ত্ত করতে শিশুর কয়েকদিন সময় লাগে। ধৈর্য ধরে শিশুকে বুকের দুধের সঙ্গে এই সব পরিপূরক আহারে অভ্যস্ত করতে হয়। খাদ্য হিসেবে গলা ভাত, আলু সেদ্ধ, চিঁড়ে ভেজা, নরম পাকা কলা, ডিমের কুসুম দেওয়া যেতে পারে। প্রথম প্রথম শিশু এ সব মুখে তুলতে চায় না। ফেলে দেয়। তখন অনেকেই ভয় পেয়ে বুকের দুধই চালিয়ে যান অথবা কৌটোর দুধ, সাবু, বার্লি ইত্যাদি খাওয়াতে থাকেন। যাঁরা দুধ খাওয়ান, তাঁরা আবার বদহজমের ভয় দুধ পাতলা করে দেন। সঙ্গে থাকে বোতলের ব্যবহার। এই দুটোই শিশুস্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক। অনেক পরিবারের লোকজন কেবলমাত্র বার্লি খাওয়ান, যার খাদ্যগুণ খুব কম।
বুকের দুধ থেকে শক্ত আহারে উত্তরণকে বলা হয় ‘উইনিং পিরিয়ড’। এটা ঠিক মতো না হলে বাচ্চা অপুষ্টির শিকার হবেই। বাচ্চাকে শক্ত আহার দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা গণ্ডগোল পাকায় অন্নপ্রাশন প্রথা। অনেক সময় পঞ্জিকাতে শীঘ্র শুভদিন না থাকায় অন্নপ্রাশন দেরি করে হয়। তাতে বাচ্চাটির শক্ত আহার পেতে অনেক সময় বেশ দেরি হয়ে যায়।
শক্ত আহার খাওয়ানোর কথা উঠলেই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই বাজারের নামকরা পরিপূরক আহারের পিছনে ছোটেন এবং সেগুলি দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে গিয়ে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন। অথচ, বিভিন্ন ধরনের খাবার না খেলে সেগুলি পরিপাক করার জন্য শরীরের মধ্যে উৎসেচক তৈরি হয় না। তাই বাজারি খাবারের উপরে নির্ভর না করে পরিবারের যা খাওয়া হয়, তা-ই শিশুকে অভ্যস্ত করাতে হয়। সঙ্গে সম্ভব হলে দু’বছর পর্যন্ত বুকের দুধ চালিয়ে যাওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে দেখতে হবে মা যেন নিজে অপুষ্টি, রক্তাল্পতা বা অন্য কোন রোগে না ভোগেন। এর মধ্যে গর্ভবতী হওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়।
ঠিকমতো অভ্যাস করালে ন’মাসের বাচ্চা বাবা মায়ের সঙ্গে সব কিছু খেয়ে নেবে। এ ছাড়া, তাকে খিচুড়ি, দালিয়া জাতীয় খাবারের সঙ্গে ডিম সেদ্ধ দিতে পারলে খুব ভাল হয়। বিভিন্ন রকমের ফল যেমন কলা, পেঁপে, আপেল ইত্যাদি দেওয়া দরকার। স্কুলে যাওয়ার আগে বা স্কুলে যাওয়ার সময় শিশুদের আহারে দিকে যত্ন নেওয়া উচিত। টিকাকরণের সঙ্গে সঙ্গে রক্তাল্পতা নিরোধক আয়রন সিরাপ, কৃমির ওষুধ নিয়মিত দিতে হয়। দুর্ভাগ্য এই সময় বিজ্ঞাপনের মোহে ভুলে মা বাবারা একটি বিশেষ কোম্পানির ছোটদের জন্য নামাঙ্কিত স্বাস্থ্য-পানীয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। স্বাস্থ্য-পানীয় খাওয়ানো যেতেই পারে কিন্তু তা কখনই সুষম খাদ্যের বিনিময়ে নয়।
আবার বহুদিনের লালিত ধারণা, অভ্যাস বা বিশ্বাসের ফলে বহু খাদ্য ক্ষতিকর মনে করে শিশু-আহার থেকে বাদ দেয়া হয়। যেমন আলু, ডিম হল ‘গরম খাবার’। বাচ্চাকে দেয়া ঠিক নয়। কলা খেলে গলা বসে যাবে, লেবু খেলে সর্দি-কাশি বা জ্বর হবে। এ রকম আরও বহু ভুল ধারণা ও অবৈজ্ঞানিক তথ্য কী ভাবে যে পুষ্টির পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।
এ জন্য গর্ভাবস্থাতেই মায়েদের পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে কবে যে এই ভুল ধারণার অবসান হবে, ঠিকঠাক বৈজ্ঞানিক ধারণার জন্ম হবে বলা মুশকিল।
লেখক প্রাক্তন জেলা মাতৃত্ব ও শিশু স্বাস্থ্য আধিকারিক, পুরুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy