কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল ‘নিশঙ্ক’ (ছবিতে) সনাতন ভারতের ঐতিহ্য এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা বলার জন্য সদাই উৎসুক। খড়্গপুর আইআইটি’র বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি টেনে আনলেন ‘রামসেতু’ প্রসঙ্গ। বললেন, “এটা কি অস্বীকার করার জায়গা আছে যে আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়াররা রামসেতু বানিয়েছিলেন? আমেরিকা, ব্রিটেন বা জার্মানি থেকে কেউ এসে বানিয়ে দিয়ে যায়নি।” প্রেক্ষাগৃহ ভরাট ছিল মেধাবী ও বুদ্ধিমান মানুষে। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা কিন্তু কেউ করেননি। একে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছেন, তার উপর বিতর্কিত বিষয়। কে আর বিতর্ক খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে? কিন্তু সব নীরবতা সম্মতি নাও হতে পারে। কাজেই পরবর্তী প্রশ্ন ভেসে এল মঞ্চ থেকে, “ঠিক কি না? সত্যি তো? বলুন না। আপনারা চুপ কেন?” এই বার মৃদু হাততালি হল।
এমন সংবাদ এসেছিল তখনও, যখন মন্ত্রী বম্বে আইআইটি’র সমাবর্তনে ভাষণ দিচ্ছিলেন— “অদূর ভবিষ্যতে কথা বলতে হলে কম্পিউটারকে তা করতে হবে সংস্কৃত ভাষার শক্তিকে ব্যবহার করেই। নয়তো কম্পিউটার ক্র্যাশ করে যাবে। কারণ সংস্কৃতই হল বৈজ্ঞানিক ভাষা।”
বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক তো আছেই, ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রকের প্রধানদের ডিগ্রি ডিপ্লোমা নিয়েও আলোচনা কম নেই। এর আগে আমরা দেখেছি, শ্রীমতী স্মৃতি ইরানির কলেজের সন্ধানে সমালোচকরা ভারতবর্ষ পেরিয়ে আমেরিকার ‘ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়’-এ পর্যন্ত খোঁজখবর চালিয়েছেন। শেষকালে নির্বাচন লড়ার জন্য নমিনেশন ফাইল করতে গিয়ে নেত্রী কলেজের কথা লিখলেনই না। রমেশ পোখরিয়ালকে নিয়েও সেই একই ব্যাপার। ভারতের সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকা এবং শিক্ষার্থী যাঁর মন্ত্রকের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাঁর শিক্ষাজীবন নিয়ে মানুষের কৌতূহল থাকবেই। কাজেই শপথবাক্য পাঠের সময় যেই তাঁর নামের আগে ‘ডক্টর’ বসেছে, অমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ শুরু। তাঁরই দলের হিমাচল প্রদেশের নেতা মনোজ বর্মা পোখরিয়ালের ‘ডক্টরেট’কে চ্যালেঞ্জ জানান। কলম্বোর ‘ইন্টারন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি’ তাঁকে দু’টি ‘সাম্মানিক ডিলিট’ দিয়েছে (কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ে) শুনেও তাঁরা নিরস্ত হন না। কারণ ওই বিশ্ববিদ্যালয় যথার্থ ভাবে স্বীকৃত নয়। শেষ পর্যন্ত আরও দু’টি ‘ডক্টরেট’-এর সন্ধান মিলল: একটি তিনি পেয়েছেন ‘গ্রাফিক এরা ইউনিভার্সিটি’ থেকে, অপরটি ‘উত্তরাখণ্ড সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে। দুটোই সাম্মানিক। সাম্মানিক ‘ডক্টরেট’ নামের আগে ব্যবহার করা চলে কি না, তা নিয়ে তর্ক চলছে।
প্রসঙ্গত, পোখরিয়ালের দু’-দু’টি জন্মদিন। একটি ডাক্তারি মতে, একটি কোষ্ঠী মতে। জ্যোতিষে তাঁর অগাধ বিশ্বাস। এক বার বলেছিলেন, “জ্যোতিষ হল শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান। এ বিদ্যা বিজ্ঞানেরও ওপর দিয়ে যায়। আমাদের উচিত জ্যোতিষের প্রচার করা।” তিনি মনে করেন, জ্যোতিষের সামনে বিজ্ঞান “বামন মাত্র”।
অবশ্য বামন হলেও বিজ্ঞানও প্রাচীন ভারত থেকেই নাকি এসেছে। “আমরা আজ পরমাণু বিজ্ঞানের কথা বলি। এক লক্ষ বছর আগে ঋষি কণাদ পারমাণবিক পরীক্ষা করে ফেলেছিলেন”, বলেছেন মন্ত্রী। আণবিক দর্শনে ঋষি কণাদের অবদান নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। কিন্তু ‘লক্ষ বছর’ আগে কণাদের ‘আণবিক পরীক্ষা’র খবর আরও অনেক প্রমাণের দাবি রাখে। পৃথিবীর প্রথম শল্যচিকিৎসার কৃতিত্ব পোখরিয়াল সুশ্রুতকে দিয়েছেন এবং দেবতা গণেশের হাতিমুণ্ড বিষয়ে ‘প্লাস্টিক সার্জারি’র উল্লেখে তাঁর সায় আছে।।
সাধ্বী প্রজ্ঞা, সাক্ষী মহারাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য ধর্মেরও নেতৃস্থানীয় অনেকেই এমন অনেক উক্তি করে থাকেন, যা আমাদের কাছে সহজবোধ্য নয়। ভারতের মতো স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিটি নাগরিকের স্বমত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। সমালোচনা আছে, এই সব বক্তব্য অনেক সময় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে মিলে যায়। দু’টি বিশেষ ব্যাপার এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেতে বাধ্য। প্রথমত, বক্তব্যগুলি জানাচ্ছেন এমন সব মানুষ, যাঁরা বিশিষ্ট জন, এমনকি মন্ত্রী। কাজেই তাঁদের কথার বিশেষ গুরুত্ব। দ্বিতীয়ত, এই সব বক্তব্য ভারত তথা বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতের মহীরুহসম ব্যক্তিবর্গ এবং কীর্তিবিষয়ক। আমাদের প্রচলিত ধারণাগুলিকে তাঁরা এই ভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছেন। আর এ সব দেখেশুনে আমরা কী করছি? দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষজন কী করছেন? ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকরাই বা কী প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন?
পোখরিয়াল মহাশয়ের ডিগ্রি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু দেশবিদেশের বিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে দিতে পারে যে মন্তব্য, তার প্রতিক্রিয়ায় নিস্তব্ধতা, মৃদু হাততালি এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে তীব্র শ্লেষাত্মক পোস্ট ছাড়া তেমন বিতর্ক উঠতে দেখা গিয়েছে কি? অথচ জ্ঞানবিজ্ঞান ও সত্যের স্বার্থে এমন বিতর্ক ওঠা দরকার। যাতে বক্তব্য রাখার আগে বক্তা, তিনি যিনিই হোন, ভাবতে বাধ্য থাকেন যে তাঁর মত কেবল হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলে হবে না, প্রমাণ দিতে হবে।
সাধনা যেখানে শক্তির সামনে মাথা নত করে আর মেধা মাথা নোয়ায় মেকি আবেগের পায়ের কাছে, সেখানে ‘চন্দ্রযান’ চাঁদে পৌঁছলেও সভ্যতার অগ্রগতি হবে না। কাজেই সুস্থ মত প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, অপ্রমাণিত মতের বিরোধিতা করতে হবে। পৃথিবীকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে সূর্যকে তার চার পাশে ওঠবস করাবার চেষ্টা অনেক হয়েছে। তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন, কেউ অবরুদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছেন। তবু পৃথিবীকেই সূর্যের চার পাশে ঘুরতে হয়েছে কারণ সত্য অসত্যকে শেষ পর্যন্ত রাস্তা ছেড়ে দেয়নি। গায়ের জোরে নয়, যুক্তির জোরে সত্যের প্রতিষ্ঠা হবেই। শুধু প্রশ্নগুলো তোলা দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy