Advertisement
E-Paper

শিশু মনে উঁকি দেয়নি সেই সব প্রশ্নেরা

স্মৃতির কপাল জুড়ে আলুথালু হয়ে চেয়ে থাকে শুধু বোবা রোদ্দুরের টিপ। এ ভাবেই পেরিয়ে যায় জীবনের কত মধুমাস! লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্যঠিক যেমন, নকশালবাড়ির আদিগন্ত সবুজ মখমলি প্রান্তরে হঠাৎ দেখা হওয়া বয়েসের ভারে ন্যুব্জ শান্তি মুণ্ডা!

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share
Save

সেদিনের শিশুমন এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়নি কারও কাছে ... সাজসজ্জা, অস্ত্রশস্ত্র, ভরা সংসার নিয়ে মণ্ডপে অধিষ্ঠিতা দুগগামার কাছে, রাতে বিছানায় শুয়ে অশীতিপর ঠাকুমার কাছে, বাড়ির গুরুজনদের কাছে, পাড়াপড়শিদের কাছে, এই রাষ্ট্রের কাছে, এই সিস্টেম-এর কাছে। সেদিন সম্বল ছিল শুধু প্রানভরা অগাধ বিশ্বাস। জীবন নদীতে ভাসতে ভাসতে কত কিছুই তো বয়ে যেতে দেখেছি। কত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ফুল, বেলপাতা, মন্ত্রোচ্চারণ! জীবনভর ঘাটে ঘাটে ভেসে যেতে দেখেছি ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত কত শত আনন্দপ্রতিমা ... সব সাজসজ্জা নিয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে, মন কেমন করা আজন্মের ভালোবাসা নিয়ে। জীবনে বয়সের পাশাপাশি চলতে গিয়ে কখনো শিউলি ফুলের সাজিতে, কখনো বা বকুল ফুলের ডালিতে, ভালোবাসার তীব্র আকুতিতে নিজেকে উজাড় করে দিতে গিয়ে কখনো কি থমকে যেতে হয়নি! তবুও কি চমক জাগেনি ... সেইসব চকচকে চোখ দেখে! বিশ্বাসকে আঁকড়ে রাখার অদম্য সাধনা দেখে! সকলের তরে, সমাজের তরে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার তরে আত্মাহুতির বিশ্ব ইতিহাসের চকচকে পাতাগুলি উলটে পালটে!

ঠিক যেমন, নকশালবাড়ির আদিগন্ত সবুজ মখমলি প্রান্তরে হঠাৎ দেখা হওয়া বয়েসের ভারে ন্যুব্জ শান্তি মুণ্ডা! তিনিও তো মা দুর্গার মতোই। ১৯৬৭-র সেই ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের’ দিনগুলোর কাছে গচ্ছিত রাখা অস্থির সময়কে বুকে আগলে রাখতে রাখতে আজ যিনি দীর্ণ, নিঃস্ব, অশীতিপর! তবুও তো আঁকড়ে প্রাণপণে বেঁচে থাকা ... আজন্মের বিশ্বাস। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের মিছিলের মর্মভেদী স্লোগান, হতাশার নির্মম তীরে বিদ্ধ ক্ষীণকায়া আশার অন্তরের স্নায়ুর ঝিলিক। আজও যিনি গর্জে উঠতে পারেন “সর্ব মঙ্গলা মঙ্গল্যে, শিবে সর্বার্থসাধিকে”। আজও যিনি ‘মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’ ... আবার এক সমাজ বদলের তোলপাড় করা দিনের জন্য দুর্দমনীয় বজ্রনির্ঘোষের প্রত্যয়ী প্রতীক্ষায়! অথবা মেচি নদীর পাড়ের রোগব্যাধিতে ক্লিষ্ট ক্ষুদন মল্লিকের মতো মানুষরা! প্রাণ ভরা বিশ্বাসকে যিনি আজও আঁকড়ে রেখেছেন ‘রক্তমনির হারে’! পিকিং-এর ‘পিপলস হলে’ মাও সে তুং এবং চৌ এন লাই-এর হাতে মেলানো হাতটায় শক্তির অনুভব যে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের শক্তির থেকে সহস্র গুন বেশি। ভারতবর্ষে ‘ইয়েনান’ গড়ে তুলতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু সে দিনের সেই বজ্রনির্ঘোষের প্রবল শক্তির কাঁধে ভড় করে গড়ে ওঠা হাতটার দিকে চেয়ে ক্ষুদন মল্লিকের মতো মানুষেরা যখন বিড়বিড় করে বলে ওঠেন ... “বিশ্বাস নষ্ট হয় নাই, মানুষের মুক্তি হবে, শোষণের শেষ হবে”। রক্তের প্রতিটি বিন্দু যেন রক্তকোষ ছিঁড়ে খানখান করে ছিটকে বেরিয়ে এসে আর্তনাদে ফেটে পড়ে ... ক্ষোভে, অপমানে, রাগে, দুঃখে, হতাশায়। অপেক্ষার পাহাড় যেন প্রবল শক্তিশালী দৈত্যের মতো আগলে রাখে মুক্তির লৌহ কপাট। তবু যেন প্রত্যয়ী প্রতীক্ষা ... কোন এক ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতার’।

কিংবা কক্সবাজারের সমুদ্রতটে অগোছালো চুলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই অন্তঃসত্ত্বা রোহিঙ্গা তরুণীটি! যার কোনও দেশ নেই! যার কোথাও ঠাঁই নেই! যার গর্ভজাত সন্তানটির গুটিপোকার খোলস ছেড়ে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসার কোনও অধিকার নেই! ভ্রূণের মুক্তহাসি এই গর্বিত বিশ্বায়নের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার আগেই যার পিতার লাস রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট জাতিদাঙ্গার হিংস্র অস্ত্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এখনো চোখ বুজলেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠে কুচকুচে কালো ধোঁওয়ার কুণ্ডলীতে। পুড়ে খাক হয়ে গেছে সব ... মেয়েবেলার অবাক করা ধু ধু প্রান্তরের হাতছানির আবেদন, কৈশোরের মন কেমনের বিকেলে অভিমানী মেঘের টসটসে গাল বেয়ে ঝরে পড়া রাশি রাশি অভিমান। এই সে দিনের সব মুহূর্তেরা আজ ঘর বেঁধেছে নিরন্তর আন্দোলিত স্মৃতির ঠিকানায়। উদ্যত রাষ্ট্রশক্তির চকচকে বেয়নেট কেড়ে নিয়েছে সব ... অতীত, কল্পনা, ভবিষ্যৎ। সমুদ্রতটের উন্মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে জগৎজননীর কাছে দু’হাত জড়ো করে সে জানতে চাইছে, “মাগোওওও ... এমনি করে কি জীবনের যত মুল্যের বিনিময়ে, বারবার কালো মৃত্যুকে হবে কেনা?” নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে উত্তর ফিরে আসে না। তবুও অবিচল সেই তরুণী ... রক্তক্ষয়ী বিধ্বস্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে শান্তির ললিত বাণী শোনার প্রত্যয়ী প্রতীক্ষায়। মায়ের মতোই। বারুদের বাতাস ছিঁড়ে খানখান করে শিউলির আঘ্রাণে আত্মজের জন্মের অধিকারের ছাড়পত্র ছিনিয়ে আনার জন্য যেন এক কালান্তরি অপেক্ষা ... যেন এক ‘শান্তিরূপেণ সংস্থিতা’-র।

সে দিনের অবোধ শিশুমন এই সব দুরূহ প্রশ্নের কোনও উত্তর খোঁজেনি কারও কাছে। সে দিনের সেই স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ কিশোরমন কোনও অধরাকেই ‘গোধরা কাণ্ডের’ প্রতিহিংসার মত্ততার আগুনে সেঁকতে শেখেনি। শুধু মনের আদিগন্ত জুড়ে ফুটে থাকা কাশফুলের কাঁপনে প্রাণ জিরিয়ে, আশ্বিনের ঝলমলে শারদ আকাশের মেঘবালিকার স্বপ্নে চোখ বুলিয়ে, মন পাড়ি দিত অমৃতলোকের অনন্ত মুক্তির ইশারায়। পারিবারিক দৈন্যদশাও যাকে ম্লান করতে পারেনি কখনো। আজও অবসন্ন দেহ-মনের আনাচে কানাচে লেগে আছে যৌবনের প্রথম লগ্নের কাকভোরের আকুতি, সেই কাজল কালো চোখের অসামান্য জ্যোতি, সেই রাঙা হাতের সোহাগি পরশখানি। শরতের মৃদুমন্দ বাতাসে কাশফুলের আশ্বাসে আঁচল ভিজিয়ে আর এক বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মন্ত্রোচ্চারণের আচ্ছন্নতায় আপ্লুত শিউলি বিছানো কাকভোরে ফি বছরের মতো একদিন এসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাজির হয় আধো আলো আধো আঁধারে ঘেরা মহালয়ার ভোর ... শিশুমনের আনাচে কানাচে, কৈশোরের আবেগের উচ্ছল প্রবাহে, ভরা তারুণ্যের উদ্দাম রক্তস্রোতে, বার্ধক্যের স্মৃতিকাতরতার আলাপে-প্রলাপে। সব প্রাচীরের অন্তরায় পেরিয়ে যেন একঘেয়ে টানাপড়েনের জীবনযাপনের অন্তে “অনন্ত মুক্তির সূর্যোদয়” ... “আঁধারে মিশে যায় আর সব” আলো।

শিক্ষক, বেলডাঙা এসআরএফ কলেজ

Nostalgia 2019 Durga Puja Special

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।