Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কেউ জেতে না, কেউ হারে না

রাজনীতির আগে লোকবিশ্বাস। অযোধ্যা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, সে বিশ্বাস বহু কালের। এ শহরে তুলসীদাস রামচরিতমানস লিখতে শুরু করেছিলেন।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

তামাম ভারত যা-ই ভাবুক, সম্প্রতি অযোধ্যা গিয়ে মনে হল, এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটির দিকে এখনও কারও চোখ পড়েনি। লোহার পাঁচিল ঘেরা শূন্যস্থান, একদা যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল, তার কথা বলছি না। ওই রাস্তায় একটু এগোলেই রামানন্দী সন্ন্যাসীদের হনুমানগঢ়ী মন্দির। রামলালা তো স্বাধীনতার পরে ১৯৪৯ সালের ঘটনা। কিন্তু তারও আগে, অষ্টাদশ শতক থেকে এই শহরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এই মন্দির।

রাজনীতির আগে লোকবিশ্বাস। অযোধ্যা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, সে বিশ্বাস বহু কালের। এ শহরে তুলসীদাস রামচরিতমানস লিখতে শুরু করেছিলেন। জনবিশ্বাস মেনে নিয়েছিলেন মুঘল সম্রাটরাও। আকবরই সারা প্রদেশের নাম রাখেন ‘অওধ’। আবুল ফজলের সাক্ষ্য, ‘‘অযোধ্যা থেকে অওধ। হিন্দুধর্মের অন্যতম অবতার রামচন্দ্র অযোধ্যাতেই জন্মেছিলেন।’’ ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘ইতিহাস ওইটুকুই। রামচন্দ্র শহরের কোথায় জন্মেছিলেন, ‘সীতা রসোই’তে সীতার রান্নাঘর ছিল কি না, এ সব নিয়ে আকবরের আমলেও কারও মাথাব্যথা ছিল না। এগুলি মুঘল আমলের শেষ দিকে, অষ্টাদশ শতকে রামানন্দী সাধুদের আখ্যান।’’ রাজনীতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বদলে যায়, নিয়ম।

সাধুসন্তদের আখ্যানও ভারতে অনেক পুরনো জায়গার ওপর নতুন আস্তর ফেলে, তৈরি হয় নতুন ইতিহাস, নতুন রাজনীতি। যেমন, সুলতানি আমলে মথুরা, বৃন্দাবন প্রায় জঙ্গল। শ্রীচৈতন্যের শিষ্যরা— রূপ, সনাতন, শ্রীজীব, গোপাল ভট্টরা তখন চিনিয়ে দিচ্ছেন, এখানেই ছিল গিরিগোবর্ধন। যমুনাপাড়ের এখানেই রাধার পায়ে কাঁটা ফুটেছিল, শ্রীকৃষ্ণ স্বহস্তে তুলে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে স্থানীয় যাদবদের সঙ্গে সে সময় তাঁদের লাঠালাঠিও হয়েছিল। পুরনো ইতিহাসে নতুন পলস্তারা ফেলেই গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা মথুরা-বৃন্দাবন-জয়পুর এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন।

এ পথে হেঁটেছিলেন রামানন্দী সাধুরাও। তাঁরা বৈষ্ণব, রাম-সীতার উপাসক। অন্য বৈষ্ণব সম্প্রদায়ও রাম-সীতাকে মানেন, কিন্তু তাঁদের রাম বিষ্ণুর অবতার। রামানন্দীদের রাম-সীতা সাক্ষাৎ ঈশ্বর। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের মধ্যে জাতপাত নেই। যে কেউ সন্ন্যাসী হতে পারেন। ফলে এখানে সন্ন্যাসীর সংখ্যা বেশি। আর এঁরা সকলে বীর যোদ্ধা। ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, মুঘল আমলের শেষে এই রামানন্দীরা কখনও রোহিলাদের ভাড়াটে সৈন্য, কখনও দল বদলে অওধের নবাবের সিপাহি দলে।

অষ্টাদশ শতকে রামচরণ দাস এ রকমই এক রামানন্দী সাধু। সরযূ নদীর ধারে আশ্রমে শিষ্যদের রামকথা শোনান। ফৈজাবাদের নবাব আসফ-উদ-দৌলা আশ্রমের খরচ চালাতে রামচরণকে কয়েকটি গ্রাম দান করলেন। এখন পিচঢালা রাজপথ। কিন্তু হনুমানগঢ়ীর দিকে সাইকেল রিকশায় যেতে যেতেই টের পাওয়া যায়, এই অঞ্চল আগে উঁচু টিলা ছিল। টিলার ওপরে দুর্গের মতো, বিশাল পাঁচিলে ঘেরা মন্দির। এই ‘দুর্গ’ নিয়েই ১৮৫৬ সালে সুন্নি ফকির ও যোদ্ধা আহমদউল্লা শাহের আপত্তি ছিল। হিন্দু সন্ন্যাসীদের এমন প্রাচীর ঘেরা, দুর্গের মতো আখড়া! লখনউয়ের শিয়া নবাবরা জেনেশুনে চোখ বুজে প্রশ্রয় দিচ্ছেন! ১৮৫৬’র নথিপত্রেই, আখড়ার অদূরে মসজিদটার নাম প্রথম মিলল। বাবরি মসজিদ।

তারও আগে ১৭৬৭ নাগাদ টিফেনথেলার নামে অস্ট্রিয়ার এক পাদ্রি অযোধ্যায় এসেছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন, এখানে রামকোট নামে একটা দুর্গ গুঁড়িয়ে তিনটি গম্বুজের একটি মসজিদ তৈরি করেছিলেন আওরঙ্গজেব। মানে, ওখানে দুর্গ ছিল। টিফেনথেলারকে তাঁর গাইড বলেছেন, এখানকার স্তম্ভগুলি হনুমান লঙ্কা থেকে নিয়ে আসেন।

এখন হনুমানগঢ়ী মন্দিরের সামনে কিছু লাড্ডু ও ফুলমালার দোকান, অতঃপর খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে যাওয়া। ভিতরে বড় বড় রুপোলি চোখের হনুমান-মূর্তি। বীর হনুমান। এঁর সঙ্গেই হজরত মহম্মদের স্নেহভাজন ইমাম আলির লড়াই। উনিশ শতকের বাংলা পুঁথিতেও আছে, ‘এতেক কহিল যদি আলী পালোয়ান/গোস্বায় জ্বলিয়া গেল বীর হনুমান।’ গৌতমবাবু বুঝিয়েছিলেন, এই আখ্যান বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের। আলি ও হনুমান লড়তেই থাকে। শেষ অবধি কেউ জেতে না, কেউ হারেও না।

ইতিহাস অযোধ্যা শহরে এমন সব বাঁক নিয়েছে, আগে বোঝা যায়নি। আহমদউল্লা শাহের প্ররোচনায় হিন্দু-মুসলমানে লড়াই যাতে না হয়, সে জন্য লখনউয়ের শেষ নবাব ওয়াজ়িদ আলি শাহ ১৮৫৬ সালে অযোধ্যায় সৈন্য পাঠিয়েছেন। এক দিকে এলাকার হিন্দু জায়গিরদার মানসিংহ, বিপক্ষে আহমদউল্লা শাহের সেনারা। পরের বছর, সিপাহি বিদ্রোহের সময় আবার মানসিংহ এবং আহমদউল্লা শাহ একযোগে লড়তে গেলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে। হিন্দু-মুসলিম বিভাজন কোনও দিন অযোধ্যায় শেষ কথা বলেনি।

হিন্দু-মুসলিম পরের কথা। হনুমানগঢ়ীর আখড়ায় প্রথম মারপিট শৈব বনাম বৈষ্ণব। আঠারো শতকে রাজস্থানে রামানন্দী সাধু বালানন্দ শৈব সন্ন্যাসী অনুপগিরিকে খুনের চেষ্টা করলেন। তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রতিশোধ নিতে ছাড়লেন না। বৈষ্ণব তীর্থ বৃন্দাবনে নিজের নামে একটা ঘাট বানালেন। রাম-সীতা, রাধাকৃষ্ণ যা-ই করো না কেন, নদীর ঘাট থাকবে অনুপগিরির নামে। তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিশোধ নিতে অযোধ্যায় শৈব সন্ন্যাসীদের আখড়া দখল করে আরও বড় দুর্গ বানালেন রামানন্দীরা। অযোধ্যা ছোট শহর, কিন্তু হনুমানগঢ়ী দু’শো বছর আগেই হয়ে উঠেছিল মথুরা-রোহিলা-জাঠ-মারাঠা-আফগান এবং সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্রীড়াক্ষেত্র।

সে-দিন হনুমানগঢ়ীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চমকে গিয়েছিলাম। এই খাড়াই সিঁড়ি কোথায় দেখেছি! মনে পড়ল, লখনউয়ের বড়া ইমামবাড়া। সেখানেও অবিকল এই রকম সিঁড়ি সটান উঠে গিয়েছে। বৈষ্ণব সাধু রামচরণ দাসকে যিনি আখড়া তৈরির জমি দিয়েছিলেন, সেই নবাব আসফ-উদ-দৌলাই তো পারিবারিক বিবাদে রাজধানী সরিয়ে লখনউতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তৈরি করেছিলেন বড়া ইমামবাড়া।

এত যুদ্ধ, এত ষড়যন্ত্র তবু ইতিহাসের সিঁড়ি অটুট থেকে যায়!

অন্য বিষয়গুলি:

Ayodhya Case Babri Masjid Ram Janmabhoomi Ayodhya Verdict Ram Temple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy