Advertisement
E-Paper

‘জল কোথায় যে হাত ধোব?’

ফুটপাথে গাদাগাদি করে বাস। লজ্জা আর আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নর্দমার ধারে এখনও বসতে হয় শৌচের জন্য।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২০ ০০:২৭
Share
Save

উত্তর কলকাতার জোড়াবাগানের ফুটপাথে পলিথিন টাঙানো একফালি জায়গা। ছেঁড়া-ময়লা একটা তোষকের উপর রাখা মোবাইলে খবরের চ্যানেল চলছে। দেখতে-দেখতে ব্যঙ্গের হাসি হাসেন বছর কুড়ির সুজাতা ঘড়াই। ‘‘করোনা রুখতে বার-বার হাত ধুতে বলছে। আমাদের পায়খানা করে ধোওয়ার মতো জল নেই, এমনি-এমনি হাত ধোব?’’

ফুটপাথে গাদাগাদি করে বাস। লজ্জা আর আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নর্দমার ধারে এখনও বসতে হয় শৌচের জন্য। কাছাকাছি একটা সুলভ শৌচাগার রয়েছে। মূত্রত্যাগ করতে গেলে প্রতি বার তিন টাকা দিতে হয়। এক পরিবারে চারজন দিনে চারবার গেলেই মোট আটচল্লিশ টাকা। মেয়েরা বাথরুম ব্যবহার করেন শুধু মলত্যাগের জন্য (পাঁচ টাকা) এবং ঋতুর সময়।

টাকা দিয়েও পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ বাথরুম মেলে না। সুজাতারা জানান, মহিলাদের বাথরুমের ছিটকিনি বেশির ভাগ সময় ভাঙা থাকে। আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে কিছু পুরুষ। টিটকিরি, দরজায় ধাক্কা, টোকা মারা, সবই চলে। মহিলা গার্ড নেই, পুরুষ রক্ষীদের মৌখিক নিগ্রহ ও অশ্লীল ইঙ্গিতের মুখেও পড়তে হয় মেয়েদের। বাথরুমে জলের ব্যবস্থা নেই। বাইরে থেকে জল টেনে নিয়ে যেতে হয়। ফলে নামমাত্র জলে কাজ সারতে হয়। ঋতুকালে ব্যবহৃত কাপড় পরিবর্তন করতে এবং ধুতে প্রাণ বেরিয়ে যায় মেয়েদের। রাত ৯টা বাজলেই সেই টয়লেট বন্ধ হয়ে যায়। তার পরে ভরসা সেই রাস্তা।

২০১৮ সালের মে মাসে ভারতের ছ’টি শহরে ফুটপাথবাসী ও অনথিভুক্ত বস্তির ১৫-২৯ বছরের মেয়েদের বাথরুম পরিষেবার পরিকাঠামো নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। কলকাতার সাতটি এলাকার (হেস্টিংস, দক্ষিণেশ্বর, বাগবাজার, জোড়াবাগান, ধাপা, রাজাবাজার ৩৬ ও রাজাবাজার ২৯ নম্বর ওয়ার্ড) দুশো মেয়ের সঙ্গে কথা বলা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে উঠে এসেছে শহরের বস্তিবাসী ও ফুটপাথবাসী মেয়েদের শৌচাগার পরিষেবার শোচনীয় অবস্থার চিত্র।

রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ২০১০ সালে নিরাপদ পানীয় জল ও শৌচ পরিষেবা মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি পায়। ‘স্বচ্ছ ভারত মিশন’ উন্মুক্ত স্থানে শৌচ বন্ধ করতে দায়বদ্ধ। সরকারি পরিসংখ্যান, দেশের শহরাঞ্চলে চল্লিশ লক্ষের বেশি বাড়িতে শৌচাগার ও প্রায় আড়াই লক্ষ গণ-শৌচালয় তৈরি হয়েছে। তার পরেও অগণিত ফুটপাতবাসী ও বস্তিবাসী মহিলা পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের অভাবে নরকযন্ত্রণা ভোগ করছেন। এই সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত রেশমী ভট্টাচার্য জানান, তিন ধরনের শৌচাগার পথবাসী মহিলারা ব্যবহার করেন। ‘পে অ্যান্ড ইউজ’ শৌচাগার। পুরসভার বানানো ফ্রি শৌচাগার। এবং নিজেদের বানানো অস্থায়ী শৌচাগার। অনেক জায়গায় ‘পে অ্যান্ড ইউজ’ শৌচাগারের দায়িত্ব কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিকে দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা উপভোক্তার কাছ থেকে টাকা তুলছেন, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ করছেন না। অধিকাংশ জায়গায় জল নেই।

সমীক্ষায় অংশ-নেওয়া মেয়েদের আটষট্টি শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের এলাকার গণশৌচালয় পূতিগন্ধময়, দরজা ভাঙা, জল নেই। পুরসভার বহু শৌচাগার রাতে বন্ধ থাকে। বহু মেয়ে মলমূত্র চেপে রেখে গভীর রাতে বা ভোরবেলা শৌচ সারেন রাস্তায়। পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা বলেছেন, দৈনিক গড়ে পাঁচ ঘণ্টা মলমূত্র চেপে থাকতে হয়। চুয়াল্লিশ শতাংশ জানিয়েছেন, বার বার শৌচাগারে যাওয়া এড়াতে তাঁরা দিনে মাত্র এক-দুই লিটার জল খান।

এলাকাগুলি ঘুরে দেখা গেল, বেশ কিছু জায়গায় বস্তির ভিতরে শৌচাগার রয়েছে, কিন্তু লোকসংখ্যার তুলনায় তা ভয়ানক কম। গড়ে পাঁচশো জনের জন্য রয়েছে চারটি শৌচাগার! পরিষ্কার করা হয় সপ্তাহে এক বার। ভোরে অন্ধকার থাকতে সেখানে লাইন পড়ে। ডাস্টবিন নেই, সাবানের বালাই নেই। অনেক জায়গায় আলোও নেই। মেয়েদের অভিযোগ, তাদের শৌচাগারের ছিটকিনি ভেঙে দেওয়া হয়। দরজায় ফুটো করে দিয়ে উঁকি দেওয়া, এমনকি শৌচাগারের ভিতরে গোপনে ক্যামেরা লাগানোর ঘটনাও ঘটেছে। অনেক জায়গায় আবার মেয়েদের আলাদা শৌচাগারও নেই। তাতে অস্বস্তির সীমা থাকে না মেয়েদের, বিশেষ করে কিশোরীদের।

অনেক জায়গায় বস্তিবাসীরা বস্তির পিছন দিকে বা কাছে খালের পাড়ে বাঁশ-ত্রিপল দিয়ে ঘিরে অস্থায়ী শৌচাগার বানান। বাগবাজার, বা রাজাবাজারের মতো জায়গায় সেই শৌচাগারে বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে যেতে হয়। নিরাপত্তা শূন্য। জলের অবস্থা তথৈবচ। বর্ষায় পরিস্থিতি নারকীয় হয়।

বাগবাজারের শঙ্করী কর, হেস্টিংসের নেহা কুমারী ঠাকুর, রাজাবাজারের বেবি খাতুন, ধাপার পৌষী মণ্ডলেরা নিজেদের বুঝিয়েছেন, বড় শহরে কোনও ক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে এই না কত! নিখরচায় ভাল বাথরুমের অনুরোধ করলে চোখরাঙানি জোটে স্থানীয় পুরকর্তার। ফুটপাথ, বস্তির ঠাঁইটুকু থেকে উৎখাত করার হুমকি আসে। রাস্তায় ফোয়ারা, মর্মর মূর্তি, আলোকস্তম্ভ আর ফুলগাছের বাগান তৈরি হয়, শঙ্করীদের পরিচ্ছন্ন বাথরুম জোটে না।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

Health Public Toilets

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।