গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
গণধর্ষণ করে দুটো পা ধরে দু’দিকে টেনে একটা মানুষের শরীর ছিঁড়ে ফেলে যারা তারা নরপশু। গণধর্ষণের পর যারা ভেতরে রড ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি বার করে নিয়ে আসে তারা নরখাদক। যারা বম্ব ব্লাস্ট করে একসঙ্গে দুশোটা লোককে ছিন্নভিন্ন করে দেয় তারা কিলিংমেশিন। পলিটিক্যাল পাওয়ার গেমে যারা একসঙ্গে গণহত্যা করে এক হাজার লোককে নিশ্চিহ্ন করে দেয় তারা নরপিশাচ।
এটুকু লিখতেই আমার কেমন দিশেহারা লাগছে। কী লিখব? ফাঁসি চাই কি চাই না? এই নিয়ে রোজ কত বিতর্ক। আজ যদি ফাঁসি চাই-এর সপক্ষে এমন একটাও যুক্তি না দিতে পারি তা হলে এই লেখা বৃথা। প্রতি দিন এই তর্কের কোনও মানে হয় না। কিন্তু ফাঁসি বা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নিয়ে কথা বলতে গেলে দিশেহারা যে লাগে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যখন পাঁচ জন গণধর্ষণ ও বীভৎস হত্যা করার পর ধরা পড়ে তাদের বিচার হয়। দীর্ঘসূত্রতার পরও রাষ্ট্র কাউকে কাউকে সংবিধানসম্মত শাস্তি দেয়। তাদের ফাঁসি হয়। কিন্তু যখন একটা মুম্বই বিস্ফোরণ হয়, বা একটা গুজরাট দাঙ্গা হয়, যখন ওড়িশায় ধর্মযাজককে ছোট ছোট সন্তান-সহ বন্ধ গাড়ির মধ্যে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় বা একটা রেপ ভিক্টিমের বাবাকে জেলের মধ্যে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, তার পর তার বাকি পরিবারকে, উকিলকে ট্রাক চাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়, তখন বোঝা যায় যে পাগলাটে, রক্তপিপাসু খুনি আসলে এক জন কেউ নয়। অসংখ্য। অসংখ্য। তখন বোঝা যায় যে এই সব হত্যার প্ল্যান তো করে এক জন দু’জন ঠিকই, কিন্তু হাতে হাতে, অপরাধপ্রবণতা দিয়ে, টাকা দিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে, হিংস্রতা দিয়ে সেই প্ল্যান কার্যকর করে যারা তাদের প্রত্যেকের ভেতরে আদিমতম হত্যা মনোবৃত্তির অনুকরণ, প্রতি-অনুকরণ ভালগারিটি-টা রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাবা গেড়ে বসে আছে। এটা একটা প্রবৃত্তি। এর থেকে মানুষের কখনও মুক্তি হবে না। দুঃখের বিষয়, এই মাস-কে কখনও ফাঁসি দেওয়া যায় না। এদের ধরা যায় না। এদের বিচার করা যায় না। এরা আসলে ছায়া। মানুষের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা রিরংসার ছায়া।
তবু একটা কথা না বলে পারছি না। আদিম প্রবৃত্তির মধ্যে আত্মরক্ষার জন্য, খাদ্যের জন্য হত্যা ছিল, প্রভুত্ব তৈরি বা নারী দখল, সীমানা তৈরির লড়াই ছিল, হিংস্রতা ছিল। কিন্তু এত ঘৃণা ছিল কি? ভায়োলেন্স ছিল, কিন্তু এই ভালগারিটি ছিল কি? তবু আমরা আদিমতাকে বার বার দায়ী করি। এখানেই মূল কথাটা আসে। রাষ্ট্রের ধারণা তৈরি হওয়া থেকেই এই ভালগারিটির সূচনা। যখনই রাষ্ট্র তার জমির ভেতর, তার অধীনের মানুষকে, তার আশ্রিতকে আর ব্যক্তিগত ভাবে, আলাদা আলাদা করে চিনতে পারল না তখনই এই ভালগারিটির জন্ম হল।
আরও পড়ুন: অবশেষে ফাঁসি হয়ে গেল নির্ভয়ার চার ধর্ষক-হত্যাকারীর
অতএব, যেখানে শ’য়ে শ’য়েকে ধরে ফাঁসি দেওয়ার কথা সেখানে মাত্র কয়েক জনকে ফাঁসি দিতে পারার কারণে আমাদের মধ্যে ফাঁসি বা রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হত্যা নিয়ে অনেক সংশয় তৈরি হয়। আমরা অনেক সময় বলি, রাষ্ট্রের খুনি হওয়াটা মানায় না। আকর্ণ হেসে উঠে বলতে হয় যে রাষ্ট্র আসলে খুনি। তাকে প্রজাপালনে যে-মানুষের ভালর কথা ভাবতে হয় ঠিক সেই মানুষকেই প্রয়োজনে হত্যা করার অধিকার এবং এক্তিয়ার নিয়েই রাষ্ট্রের জন্ম। এটাই রাষ্ট্র। এর নামই রাষ্ট্র। আমরা মাঝেমধ্যে খুব সরল হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এই সরলতা আমাদের মানায় না। রাষ্ট্রকে বাড়ির বাচ্চার মতো আদর্শের পাঠ পড়িয়ে কে কবে কোন সভ্যতার চলন বদলাতে পেরেছে? কারণ, রাষ্ট্র আদর্শের জন্য কোনও দিন ফাংশন করে না, ওগুলো বইয়ে লেখা থাকে। রাষ্ট্র একটা মোমেন্টামের ওপর চলে। তার আদর্শ বলে কিছু নেই। তাকে যখন যেটা করতে হয় তখন সেটা করে। এই বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষকে ত্রাণ দিতে হয়, অন্য দিকে বন্যায় ভেসে ‘আসা’ মানুষকে গুলি করতে হয়। শুধু একটা থেকে আর একটা অ্যাক্ট করার ক্লু’টা নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র আদতে একটা মুণ্ডহীন ধড়। যখন যে ক্ষমতায় থাকে তখন তার মাথাটা এনে এই ধড়ের উপর বসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সে যা চায় তাই হয়। মানুষ মানুষকে মারে। রাষ্ট্র তার নিজের মানুষকে মারে। একটা রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে মারে। একাধিক রাষ্ট্র মিলে একাধিক রাষ্ট্রকে মারে। হয় মারে। আর নয় মারার ভয় দেখায়। এই ভয় দেখানোটার শেষ পর্যায়ে অপেক্ষা করে থাকে নিউক্লিয়ার বম্ব। আমরা ভাবি, এই তো বিকেলে একটু পার্কে গেলাম, দুটো ঝালমুড়ি খেলাম, বাচ্চাদের খেলা দেখলাম, ফেরার পথে ঠাকুরের ফুলটা কিনে নিয়ে ফিরলাম— এই সিমপ্লিসিটিই জীবন! না। তা নয়। ঠিক সেই বিকেলটুকুর মধ্যেই রাষ্ট্র হয়তো আবিষ্কার করে ফেলছে একসঙ্গে একটা দেশ, একটা জাতি, নারী, পুরুষ, শিশু, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ-সহ সব কিছুকে বিকলাঙ্গ করে ফেলার মতো একটা অস্ত্র।
তা হলে এর মধ্যে আমি এই ফাঁসিটাকে ঠিক কী ভাবে দেখব? ওই ছায়াগুলোর তো ফাঁসি হবে না? তা হলে এই পাঁচ জন, সাত জনের হবে কেন?
হবে। তার কারণ, আইন আছে। যারা ধরা পড়ে না, বা যারা ধরা পড়েও প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায় তাদের জন্য যাদের নৃশংস অপরাধ প্রমাণিত তাদের ক্ষমা করে দেওয়া যায় না। এদের বাঁচিয়ে রাখা একটা পাহাড় প্রমাণ চাপ। লজিস্টিকাল হ্যাজার্ড। প্রতি দিন এদের দেখাশোনা করা একটা বড় সমস্যা। চল্লিশ, পঞ্চাশ বছর ধরে এদের প্রতি দিন খাইয়ে পরিয়ে, শরীর, স্বাস্থ্যের যাবতীয় দেখাশোনা করে, প্যারোলে বাইরে যেতে দিয়ে, মানবাধিকারের মান বজায় রেখে, এক জেল থেকে অন্য জেলে পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। ধীরে ধীরে এদের সঙ্গে জেলকমীর্দের হৃদ্যতা তৈরি হয়। একটা ভয়াবহ অপরাধ করে কোনও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করা তো দূর, ক্রমশ এদের জেলের পরিবেশটা ঘর-বাড়ি হয়ে ওঠে। হাসি ঠাট্টা তামাশা গান বাজনা, সমলিঙ্গ যৌনতা, চোরাই নেশার জিনিস, পর্ন ক্লিপ, খাবার, মদ, আস্তে আস্তে সবই পায় এরা। টাকা না থাকলেও পায়। কারণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে অপরাধী বা আইনরক্ষক, উভয়ের সঙ্গেই। কিন্তু তার পরেও এদের প্রধান চিন্তা থাকে জেল পালানো। যারা এত সহজে নিরীহ মানুষ খুন করে শরীর টুকরো করে ফেলে তারা এক জন আম মানুষের থেকে অনেক ডেসপারেট। একবার পালাতে পারলেই হল- এই চিন্তাটা এদের আরও হিংস্র করে দেয়। ফলে চারপাশের মানুষের জন্যও এরা খুব বড় থ্রেট। যাদের রোজ বাধ্যতামূলক ভাবে এদের সংস্পর্শে আসতে হয় তাদের প্রাণের ঝুঁকি থাকে। এই কাজটা আমি করছি না বলে এই নরম মনোভাব দেখাচ্ছি- এই শৌখিনতার কোনও মানে হয় না। ক্রাইমের ইনটেনসিটি দিয়েই এদের জাজ করা দরকার। বছরের পর বছর সমাজের জন্য, পরিবেশের জন্য, এমনকি জেলের অন্য অপরাধী এবং কারাকর্মীদের জন্য এরা খুব বড় একটা থ্রেট। পালানোর জন্য আরও হত্যা করা এদের জন্য কিছু না।
আরও পড়ুন: বিচার পেলেন নির্ভয়া, ন্যায় পেলেন কি?
তা হলে কী দেখা গেল? অন্যায় করে অনুশোচনা করার জন্যও একটা যোগ্যতা লাগে। নরপশুদের সেই যোগ্যতা থাকে না। উপরন্তু কারাবাস ক্রমশ সহজ হয়ে আসে। এবং সব সময়েই এদের দ্বারা আরও হত্যা ইত্যাদি সংগঠিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রসঙ্গ এখানে আর টানলাম না। কারণ, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন যেমন আছে, তেমনই যার যার নিজের অপরাধ, তার শাস্তি তার তার নিজের কড়ায় গন্ডায় ভোগ করে যাওয়ার দরকারও আছে। এখানে ছেলে পিটিয়ে জামাই শাসনটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। তুমি অপরাধ করেছ। তুমি ফল ভোগ করে নাও। তাতে কেউ শিখলে ভাল। না শিখলে তাকেও সময় এলে শাস্তি দেওয়ার উপযুক্ত আইন আছে। এখানে এই তর্কগুলোর মানে হয় না যে যেখানে মৃত্যুদণ্ড বেশি সেখানে অপরাধ বেশি ইত্যাদি।
ইংরেজিতে আমরা বলি ‘টু গেট রিড অব’। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এটা খাটে। কিছু কিছু মানুষ যারা আসলে মানুষই না, রাষ্ট্রকে তাদের ঝেড়ে ফেলতে হবেই। কারণ সময় বদলে যায়, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলায়, রাষ্ট্র যদি সমাজকে এদের হাত থেকে মুক্ত না করে তা হলে অনবধানে আবার এদের ভিড়ে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকেই। এই নিকৃষ্টতম সম্ভাবনাটাকে প্রতি দিন, বছরের পর বছর জিইয়ে রাখার মজাটাকে কার ভাল লাগবে? কিছু দুঃস্বপ্নের ইতি হওয়াই মঙ্গল। আপাত শান্তিকল্যাণ।
(গ্রাফিক:শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy