Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
Workforce

অনেকখানি পিছিয়ে গেলাম

১৯৮২ সালের সংশোধনের পর থেকে আইনটি প্রযোজ্য হয় সেই সব কারখানায়, যেখানে গত এক বছরে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা গড়ে একশোর বেশি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অঙ্গারিকা রক্ষিত
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২০ ০০:০৩
Share: Save:

নতুন শ্রমবিধির মধ্যে শিল্পসম্পর্ক সংক্রান্ত বিধিটিই সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্পবিরোধ আইন, ১৯৪৭-কে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই আইনটি কারখানার স্থায়ী শ্রমিকদের কয়েকটি অধিকার দিত— যেমন, ইউনিয়ন গড়া ও ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার অধিকার। অন্য দিকে, নির্বিচারে কর্মী ছাঁটাই করা থেকে নিয়োগকর্তাদের নিরত রাখত।

১৯৮২ সালের সংশোধনের পর থেকে আইনটি প্রযোজ্য হয় সেই সব কারখানায়, যেখানে গত এক বছরে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা গড়ে একশোর বেশি। অর্থাৎ, এমনিতেই এর অধীনে পড়ে শুধুমাত্র বড় কারখানাগুলি। ভারতের শিল্পক্ষেত্রের বেশির ভাগ কারখানাই এই আইনের আওতার বাইরে, যেহেতু সেখানে শ্রমিকের সংখ্যা একশোর কম। নতুন শ্রমবিধিতে এই সীমারেখা বাড়িয়ে তিনশো করার ফলে আরও বেশি সংখ্যক কারখানা এই আইনের বিধিগুলি না মানার ছাড়পত্র পেয়ে গেল। ২০১৪-১৫ সালের অ্যানুয়াল সার্ভে অব ইন্ডাস্ট্রিজ় (এএসআই)-এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, ওই বছর সংগঠিত উৎপাদন শিল্পক্ষেত্রে ৭.২% কারখানা এমন ছিল, যেখানে একশোর বেশি স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। তিনশোর বেশি স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করে, এমন কারখানার ভাগ ছিল মাত্র ১.২%। অর্থাৎ, নতুন শ্রমবিধির ফলে শিল্পবিরোধ আইনের পরিধি আরও সঙ্কুচিত হয়ে যাবে।

পাশাপাশি বাড়বে ঠিকা বা চুক্তি শ্রমিক নিয়োগের প্রবণতা। ইতিমধ্যেই সংগঠিত উৎপাদনক্ষেত্রে মোট শ্রমিকের মধ্যে ঠিকা মজুরের ভাগ ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি। এত দিন পর্যন্ত আইন অনুযায়ী মূল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ঠিকা মজুরের ব্যবহার করা যেত না। কিন্তু নতুন শ্রমবিধি এখন সেই অনুমতিও দিয়ে দিল। অর্থাৎ, যে কারখানাগুলি তিনশোর বেশি শ্রমিক নিয়োগ করে, তারাও এখন স্থায়ী শ্রমিকের বদলে মূল উৎপাদনের কাজে ঠিকা মজুর নিয়োগ করে নিজেদের শিল্পবিরোধ আইনের পরিসরের বাইরে রাখতে পারবে।

এর পরে যে মুষ্টিমেয় কারখানাতে শিল্পবিরোধ আইনের বিধি প্রযোজ্য হবে, সেখানেও শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকারে আনা হয়েছে নানা রকম শর্ত। যেমন, ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার অন্তত ১৪ দিন আগে নোটিস দিতে হবে, শিল্প-আদালতে কোনও প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ধর্মঘটে যোগ দেওয়া যাবে না ইত্যাদি।

সুতরাং, শিল্পবিরোধ আইনের বিধিগুলি এখনও খাতায়-কলমে বিদ্যমান থাকলেও, নতুন শ্রমবিধি সেগুলিকে ব্যবহারিক ভাবে অকেজো করে তোলার উপযুক্ত আইনি কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে। শ্রম আইনকে সরল করার নামে নতুন শ্রমবিধি আসলে শ্রমিকদের বঞ্চিত করছে সমস্ত কর্মসংস্থানগত সুরক্ষা থেকে। তবে এটিকে উপস্থাপিত করা হচ্ছে এমন সংস্কার হিসেবে, যেন এটি নিয়োগকর্তাদের আরও বেশি শ্রমিক নিয়োগের নমনীয়তা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করবে।

কিন্তু, শিল্পবিরোধ আইনের ফলে যে শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বা বিনিয়োগের বৃদ্ধি সীমিত হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ আছে কি? অর্থনীতিচর্চার জগতে যে গবেষণাগুলি এ রকম দাবি করেছে, তাদের অধিকাংশই তীব্র ভাবে সমালোচিত হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ গবেষণাপদ্ধতির জন্য। এ দিকে অ্যানুয়াল সার্ভে অব ইন্ডাস্ট্রিজ়-এর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পনেরো বছরে, ভারতের সংগঠিত উৎপাদন খাতে বেশির ভাগ কর্মসংস্থানই হয়েছে বড় কারখানায়, যেগুলির অধিকাংশেরই শিল্পবিরোধ আইনের আওতায় পড়ার কথা। এই সময়কালে মোট বিনিয়োগের সিংহভাগও হয়েছে ওই কারখানাগুলিতেই। ২০০০-০১ থেকে ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে সমস্ত বিনিয়োগের ৮৫ শতাংশেরও বেশি এমন কারখানায় হয়েছে, যেখানে মোট একশোর বেশি শ্রমিক নিযুক্ত ছিল। তা হলে?

বর্তমানে ভারতে বেকারত্বের হার ঐতিহাসিক শীর্ষে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এমন শ্রমনীতি সংস্কার, যা নমনীয়তার নামে নিয়োগকর্তাদের যথেচ্ছ ছাঁটাইয়ের সুবিধা করে দেয়, তা বেকারত্বের পরিস্থিতিটিকে আরও গুরুতর করে দিতে পারে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতে সংগঠিত উৎপাদন খাতে নেট আয়ে লাভের অংশ ৫৫ শতাংশেরও বেশি এবং মজুরির ভাগ মাত্র ১৮ শতাংশ।

২০১৪-১৫ সালে এক জন ঠিকা শ্রমিকের গড় মাসিক মজুরি ছিল ৮৫০০ টাকা, যা স্থায়ী শ্রমিকের গড় মজুরির মাত্র ৭০ শতাংশ। নতুন শ্রমবিধি ঠিকা মজুরের ব্যবহারকে উৎসাহ দিলে শ্রম ও পুঁজির এই বৈষম্য আরও মারাত্মক হবে।

উন্নত মানের কর্মসংস্থান, শ্রমের ন্যায্য মজুরি এবং শ্রমিকদের অধিকার ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি সভ্যতার প্রগতির প্রতীক। বহু বছরের সংগ্রামের ফলে এগুলি অর্জন করার যে পথে আমরা খানিক দূর এগিয়েছিলাম, আজ আবার সেই পথেই এক লাফে পিছিয়ে যাচ্ছি অনেক অনেক বছর। ইতিহাসের সরণি ধরে এই পশ্চাদ্গমন বিবর্তনের কোন পর্যায়ে গিয়ে আমাদের দাঁড় করাবে?

অন্য বিষয়গুলি:

Workforce Work regulations
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy