কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়েও উত্তর-পশ্চিম ভারতের কৃষিসমাজ বিনা শর্তে নতুন কৃষি আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করার দাবিতে অবিচল। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে, এত দিন পরেও অনড় মনোভাবের কারণ কী? বিলের কোন ব্যাপারে তাঁরা ক্ষুব্ধ? কোথায় এই বিলের অসম্পূর্ণতা? আরও বড় পরিসরে প্রশ্ন হল, এই বিল এবং আন্দোলনের কি কোনও সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন এবং বিনিয়োগের উপর?
এই বিল সম্পর্কিত দু’টি বিষয় সবচেয়ে বেশি চর্চিত ও বিতর্কিত। এক, এখন কৃষক উৎপাদনের আগেই তাঁর কৃষিজাত পণ্যের মূল্য এবং সরবরাহের পরিমাণ এক জন ক্রেতার (যেমন, বিভিন্ন বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থা) সঙ্গে আগাম চুক্তির মাধ্যমে ঠিক করতে পারবেন। দুই, কৃষক এখন স্বাধীন ভাবে, যেখানে ইচ্ছে, উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারেন। এমনকি, চাইলে তাঁরা যেতে পারেন ভিন্ন প্রদেশের বাজারেও। অর্থাৎ, এই বিলের মূল বক্তব্য অনুসারে, উৎপাদনের আগে এবং পরে কৃষকের একটা স্বাধীনতা থাকছে কোথায়, কী ভাবে ও কতটা কৃষি পণ্য বেচতে পারবেন, তার উপর। যুক্তি বলবে, তাঁরা এই বিলের আগে যা করতে পারতেন, সেটাও যদি বজায় থাকে, তা হলে তাঁরা আরও নতুন উপায়ে ফসল বিক্রি করতে পারেন, এবং সেটা তাঁদের অনুকূলেই যাওয়ার কথা। তা হলে এত ক্ষোভ কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আগে অন্য কয়েকটা প্রশ্ন করা প্রয়োজন। যেমন, কৃষি অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য কী? কৃষিতে বিভিন্ন অংশীদারের সম্পর্কের রূপরেখাই বা কেমন? কৃষি অর্থনীতির মূল নিয়ামক এবং পরিচালক হল তার বিভিন্ন পর্যায় এবং স্তরে থাকা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, এবং তার থেকে প্রতিফলিত ব্যবসায়িক ঝুঁকি, যেটা বহন করেন এই অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত অংশীদারেরা, যাঁদের সিংহভাগ হলেন কৃষকেরা। তা ছাড়াও আছে মহাজন, আড়তদার, ব্যাঙ্ক, সরকার ইত্যাদি।
সরকার যখন কোনও নতুন নীতি প্রণয়ন করে, স্বভাবতই তার প্রভাব পড়ে প্রধান অংশীদার কৃষকদের এই ঝুঁকি বহন করার ক্ষমতার উপর। তার পর সেটা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র সমাজে। এই ঝুঁকিকে দু’ভাগে ভাগ করে দেখা যায়— এক, ফসল তোলার আগে অর্থাৎ উৎপাদন চলাকালীন ঝুঁকি; দুই, ফসল তোলার পর, বিক্রি-বাটার সময়কার ঝুঁকি। প্রথম পর্যায়ের ঝুঁকির ভার সম্পূর্ণ বহন করতে হয় কৃষকদেরই। কারণ, জমিতে বীজ বপন, সার, কীটনাশক ও প্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদির ব্যবস্থার এবং খরচের দায় বর্তায় কষকের উপর। যদি খরা, বন্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসলের ক্ষতি হয়, তবে ঋণের উপর নির্ভরশীল বিমাহীন দরিদ্র কৃষক সর্বস্বান্ত হতে পারেন। সেই ঝুঁকির ভার পড়ে কৃষকদের জীবনের উপর। কৃষকদের আত্মহত্যার পিছনে একটা বড় কারণ এই ঝুঁকি। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে নথিভুক্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ পরিবার ছোট এবং প্রান্তিক। এঁদের আবাদযোগ্য জমির মালিকানা পরিবার পিছু দুই হেক্টরের কম। এঁদের মধ্যে ৬৮ শতাংশের জমি ১ হেক্টরের কম। এই কৃষকদের কথা মাথায় রাখলে স্পষ্ট যে, কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন কৃষি আইনগুলি অসম্পূর্ণ, কারণ তাতে প্রাক্-ফসল উৎপাদন সময়কালীন ঝুঁকি ও তার বিমা সম্পর্কে একটি কথাও নেই। এর আওতা থেকে সম্পূর্ণ বাদ গিয়েছেন দেশের কোটি কোটি স্বল্প জমির মালিক কৃষক।
চাষবাসের প্রথম পর্যায়ের উৎপাদনের অনিশ্চয়তা যদি আসে প্রকৃতির রোষ থেকে, তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যবসায়িক ঝুঁকি আসে ফসলের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ার ভিতরকার অনিশ্চয়তার জন্য, যেটা মূলত ফসলের জোগান, চাহিদা ও বিক্রয় পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। এই মুহূর্তে, ফসল বিক্রির জন্য এক জন কৃষকের কাছে দু’টি রাস্তা খোলা। এক, কৃষক নিজের রাজ্যে মান্ডিতে খোলা বাজারে নিলামের দর হাঁকাহাঁকির মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করতে পারেন। কৃষক ছাড়াও এখানে আসেন বিভিন্ন মাপের আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাঁদের হাত ঘুরে খাদ্যপণ্য পৌঁছয় খুচরো বাজারে, গৃহস্থের হেঁশেলে। দুই, তাঁরা সরকারি প্রতিষ্ঠান ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়াকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে পারেন।
খোলা বাজারে বিক্রির ঝুঁকি আছে। যদি সারা দেশে চাল, ডাল ইত্যাদির জোগান উপচে পড়ে, তা হলে খোলা বাজারে তার দাম পড়বে। উপভোক্তা উপকৃত হবেন, কিন্তু চাষি মার খাবেন। উৎপাদন কম হলে আবার ছবিটা উল্টে যাবে। অন্য দিকে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কোনও ঝুঁকি নেই, কারণ সেখানে খাদ্যপণ্যের দাম পূর্বনির্দিষ্ট। প্রশ্ন হল, কৃষকরা কোথায় যাবেন তা হলে? এফসিআই, না মান্ডি?
কৃষক তাঁর উদ্বৃত্ত ফসলের কতটা সরকারের ঘরে, আর কতটা মান্ডিতে বিক্রি করবেন, সেটা মূলত নির্ভর করছে উদ্বৃত্ত শস্যের পরিমাণের উপর, যেটা আবার নির্ভর করছে কৃষি পরিবারের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণের মালিকানার উপর। ভারতে আবাদযোগ্য জমির গড়পড়তা পারিবারিক মালিকানা সবচেয়ে বেশি, পঞ্জাব (২.৭২ হেক্টর), হরিয়ানা (২.০৭ হেক্টর) এবং রাজস্থানে (২.৪৩ হেক্টর)। অন্য দিকে, সবচেয়ে কম পশ্চিমবঙ্গ (০.৪৪ হেক্টর), কেরল (০.১৫ হেক্টর) ও বিহারে (০.৪৩ হেক্টর)। আবার, পঞ্জাবে ৮৯%, হরিয়ানায় ৮৫% চাল সরাসরি এফসিআই-কে বিক্রয় করা হয়। ফলে, সেখানকার কৃষকেরা মান্ডির বাজারদরের ওঠানামার অনিশ্চয়তা থেকে বহুলাংশে মুক্ত ও ঝুঁকিহীন। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গে মোট উৎপাদনের মাত্র ৭.৩ শতাংশ চাল বিক্রি করা হয় এফসিআই-কে, বিহারে ১.৭%। অর্থাৎ, ছোট জোতের চাষ যেখানে, সেখানে উদ্বৃত্ত ফসল এত কম যে, তার বেশির ভাগটাই চলে যায় পরিবারের খাওয়া খরচায়। সেই কৃষকেরা তাঁদের উদ্বৃত্ত মান্ডিতে বিক্রি করেন মূলত আড়তদারদের মধ্যস্থতায়।
এখান থেকে আঁচ পাওয়া যাচ্ছে যে, কেন পঞ্জাব ও হরিয়ানাতে কৃষকেরা উত্তাল, কেনই বা অন্য জায়গায় (বিশেষত পূর্ব বা দক্ষিণ ভারতে) নয়। চাষির জোত যত বড়, তাঁর উদ্বৃত্ত শস্য ততটাই বেশি। আধুনিক অর্থনীতির ‘ক্ষতির প্রবণতা এড়ানোর তত্ত্ব’ অনুযায়ী বড় চাষিরা নির্দ্বিধায় বেছে নেবেন এফসিআই-এর কাছে ফসল বেচতে। কারণ, খোলা বাজারে দাম নিম্নমুখী হলে তবেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কৃষকের কাছে আকর্ষক। তাই সরকার যখন আরও অনেক খোলাবাজার তৈরির কথা বলছে, পঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা দেখছেন সিঁদুরে মেঘ। তাঁদের আশঙ্কা— এফসিআই বলতে পারে যে, খোলাবাজারের সংখ্যা এখন যে হেতু অনেক, তাই সরকারি সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা কম। এতে শুধু যে কৃষকদের ঝুঁকির পরিমাণ বাড়বে তা-ই নয়, হ্রাস পাবে মান্ডির নিলামে তাঁদের দরাদরির ক্ষমতা, কারণ বিকল্প পথে বিক্রির সুযোগ কমবে।
যে সব ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি স্থিতিশীল, অর্থনীতির তত্ত্ব বলবে, সে সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের হার, দুই-ই বেশি হয়। গত বছর সেপ্টেম্বরের হিসেব অনুসারে, এফসিআই-এর গুদামে সাত কোটি টনেরও বেশি চাল-ডাল মজুত ছিল। এটা উত্তর-পশ্চিম ভারতের কৃষকদের দীর্ঘ দিনের বিনিয়োগের ফল, যেটা গড়ে উঠেছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের মজবুত কাঠামো ও পরিকল্পনার জন্য। লকডাউন চলাকালীন দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তেও যে চাল-ডাল পৌঁছেছে, তার কারণ এফসিআই-এর গুদামে উপচে পড়া খাদ্যশস্য, যার উৎস মূলত পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষিক্ষেত্র। কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগের উপর এই নতুন আইনের বিরূপ পরিণামের কথা না ভেবে কেন্দ্রীয় সরকার আগুন নিয়ে খেলছে।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হল, অগ্রিম মূল্যের ভিত্তির উপর চুক্তি-চাষের গ্রাহ্যতা। এই ক্ষেত্রে কৃষকসমাজের ক্ষোভ খুবই যুক্তিসঙ্গত। যেখানেই ক্রেতা ও বিক্রেতা অগ্রিম মূল্য নির্ধারণ করে ভবিষতের অর্থনৈতিক লেনদেনের সূচনা করেন, সেখানেই এক বড় সমস্যা হচ্ছে চুক্তিখেলাপের প্রবণতা। ভবিষ্যতে, যদি খোলাবাজারে শস্যের দাম অনেকটাই কম হয় অগ্রিম চুক্তির মূল্যের থেকে, তা হলে ক্রেতার প্রবণতা থাকে বাজার থেকেই সেই পণ্য কিনে নেওয়ার। তখন চুক্তিবদ্ধ কৃষক ধনেপ্রাণে মারা পড়তে পারেন তাঁর বিক্রি না-হওয়া ফসল নিয়ে। অন্য দিকে, খোলাবাজারে দাম অপেক্ষাকৃত বেশি হলে কৃষকও চুক্তিভঙ্গ করতে পারেন। বাস্তব ক্ষেত্রে এই ধরনের খেলাপি ঘটে প্রতিনিয়তই। তাই এই ধরনের বিনিময় কার্যকর করার জন্য আইনগত এবং প্রতিষ্ঠানগত কাঠামো সুপরিকল্পিত ভাবে মজবুত করার দরকার হয়। না হলে অগ্রিম চুক্তির ব্যাপারটাই মাঠে মারা যায়। কৃষি আইন এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব।
তাই, ফসল তোলার আগের ঝুঁকির বিমার ব্যবস্থা না করা, চুক্তি-চাষের জন্য পরিকাঠামোর অনুল্লেখ, নতুন বাজার প্রবর্তন করে সহায়ক মূল্যের রক্ষাকবচ গুটিয়ে ফেলার সন্দেহ— সব মিলিয়ে কৃষকসমাজের ক্ষোভের কারণ বোঝা যায়। আর, সরকারকে বিশ্বাস করাও তো কঠিন, তাই না?
অর্থনীতি বিভাগ, নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy