বিগত বৎসর জাতীয় শিক্ষানীতির প্রথম খসড়ায় উল্লিখিত ত্রি-ভাষা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হইয়াছিল। খসড়ার একটি অংশ হইতে প্রতীয়মান হইতেছিল, সকল রাজ্যের জন্যই হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করিবার প্রস্তাব করিতেছে কেন্দ্রীয় সরকার। শেষাবধি খসড়া কমিটির প্রধান কে কস্তুরীরঙ্গন জানাইয়াছিলেন, ভ্রান্ত ব্যাখ্যার ফলেই এই রূপ প্রমাদ। বৎসরকাল অতিক্রান্ত হইল, খসড়াটি স্থায়ী নীতির রূপ পাইল, কিন্তু হিন্দি চাপাইয়া দিবার অভিযোগটি রহিয়াই গেল। কিমাশ্চর্যম্, এই বারেও সরকার কর্তৃক সেই ‘ভ্রান্ত ব্যাখ্যা’র তত্ত্বটিই শুনানো হইতেছে! প্রশ্ন হইল, যে শিক্ষানীতির অন্যতম স্তম্ভ মাতৃভাষায় লেখাপড়া, সেইখানে ভাষার প্রশ্নে পুনঃপুন এমন প্রমাদের সুযোগ থাকিবে কেন? বিশেষজ্ঞেরা খসড়ায় যে সংশোধন ও পরিমার্জনের কথা বলিয়াছিলেন, তাহাকেই বা সম্পূর্ণ অবহেলা করা হইল কেন? সরকার জানাইয়াছে, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়ালের সহিত সমস্ত রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হইয়াছে, এবং অধিকাংশ রাজ্য মাতৃভাষায় লেখাপড়া করাইবার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাইয়াছে। কিন্তু ইহাও সত্য যে, নূতন শিক্ষানীতি দেখিয়া সেই মন্ত্রীদের কণ্ঠেই হিন্দি চাপাইয়া দিবার আশঙ্কাটি শুনা গিয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আশ্বাসে কেন কাজ হইল না, কোথায় ফাঁক থাকিয়া যাইল, তাহা বুঝিতে হইলে নীতি সংক্রান্ত কয়েকটি সমস্যার অভিমুখে নজর দেওয়া আবশ্যক।
প্রথমত, ভারতের ন্যায় বহুভাষিক দেশে প্রতিটি রাজ্যের ভাষিক চিত্র স্বতন্ত্র। ভাষানীতি নিজ নিজ রাজ্যের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার অধীনে থাকিলে হিন্দি আসিয়া পড়িবার আশঙ্কা অমূলক নহে, বিশেষত যেখানে ‘জাতীয় ঐক্য’-এর যুক্তিটি হাজির। কয়েক দশক পূর্বে কেন্দ্রীয় ত্রি-ভাষা নীতির পাল্টা তামিলানাড়ুতে দ্বি-ভাষা নীতি প্রণয়ন করিয়াছিলেন ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী আন্নাদুরাই। নূতন শিক্ষানীতিটি খারিজ করিয়া তাহারই উল্লেখ করিয়াছেন সেই রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী পলানীস্বামী। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ অহিন্দিভাষী রাজ্যেই তৃতীয় ভাষা শিখাইতে গিয়া বিতর্কের জন্ম প্রায় অবশ্যম্ভাবী। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাউক। বাংলা ও ইংরাজি ব্যতীত তৃতীয় কোনও স্থানীয় ভাষা বাছিতে হইলে এতগুলি দাবিদার উঠিয়া আসিবে, যে তাহার নিষ্পত্তি করা প্রায় অসম্ভব। এই ক্ষেত্রে বিতর্ক এড়াইতে শেষাবধি হিন্দিকে বাছিয়া লওয়াই প্রশাসনের পক্ষে সহজ-স্বাভাবিক পথ। তৃতীয়ত, নূতন শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি অবধি আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষায় লেখাপড়া করা যাইবে, নবম শ্রেণি হইতে মাধ্যম হিন্দি বা ইংরাজি। ইহার অর্থ, উচ্চশিক্ষায় এত কাল নানা ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে পড়িবার যে সুযোগ ছিল, তাহা লোপ পাইতেছে। একমাত্র ভারতীয় ভাষা হিসাবে হিন্দির প্রতিষ্ঠার পথই সুগম হইতেছে না কি?
ত্রি-ভাষা নীতির গলদটি আসলে গোড়ায়। ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার যখন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নীতিটি তৈয়ার করিয়াছিল, তখন অহিন্দিভাষী রাজ্যে আঞ্চলিক ভাষার সহিত হিন্দি ও ইংরাজি বাধ্যতামূলক করিবার কথা জানাইয়াছিল। তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশের ন্যায় রাজ্যের অসম্মতিতে তাহা বাস্তবায়িত হয় নাই। এই বারের পর্ব অধিক কুয়াশাচ্ছন্ন। ত্রি-ভাষা নীতি চালু করিয়াও বলা হইতেছে যে, হিন্দি বাধ্যতামূলক নহে। ভারত সামান্য বহুভাষিক দেশ নহে, ইহার বহু ভাষা সংবিধানস্বীকৃত, তাহা জাতীয় প্রতীকস্বরূপ। অতি সংবেদনশীল এই বিষয় লইয়া এই রূপ লুকোচুরি কূট সন্দেহ বাড়ায়। এত কাল নানা রাজ্যে প্রচলিত শিক্ষানীতিতে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল, এক বা একাধিক আঞ্চলিক ভাষা শিখিতেও বাধা ছিল না। তবে আর নূতন করিয়া ত্রি-ভাষা নীতি কেন? দ্বি-ভাষা নীতির রাজ্যে খিড়কির দরজা দিয়া হিন্দি চাপাইয়া দিবার আশঙ্কাই থাকিয়া গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy