ধর্ষণ বস্তুটা নিয়ে রাজনীতি করা চলে, কি চলে না, সে বিষয়ে নরেন্দ্র মোদীর মত পাঁচ ছ’বছরে বিলক্ষণ পাল্টেছে। ২০১৪ সালে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ভোট দেওয়ার সময় নির্ভয়ার কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। ২০১৮ সালে তাঁর মত, একটা আট বছরের মেয়ের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা অনুচিত। তাঁর মত পাল্টাল কেন, ভাবার প্রয়োজন নেই— মত যখন তাঁর, পরিবর্তনের অধিকারও বিলক্ষণ তাঁর।
তবে, মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, নির্ভয়া-কাণ্ড আর কাঠুয়ার আট বছরের মেয়েটির ধর্ষণ কিন্তু এক নয়। নৃশংসতার তারতম্য বিচারের প্রয়োজন নেই— এক ধর্ষণের সঙ্গে অন্য ধর্ষণ, এক খু্নের সঙ্গে অন্য খুনের তুলনা হয় না কখনও। কিন্তু, প্রেক্ষিতের তুলনা হয়। নির্ভয়ার ধর্ষণের পিছনে রাজনীতি ছিল না, ধর্ম ছিল না। ছিল শুধু কিছু বর্বর পুরুষের নৃশংসতা। জম্মুর মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে রাজনীতির হাতে, তাকে হত্যা করেছে সাম্প্রদায়িকতা। নির্ভয়া-কাণ্ডকে রাজনীতির প্রশ্ন করে তোলার বাধ্যবাধকতা ছিল না। নরেন্দ্র মোদীরা করেছিলেন। কাঠুয়ার ধর্ষণকে রাজনীতি ছাড়া ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। নরেন্দ্র মোদী রাজনীতি এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
কাঠুয়ার শিশুটি ছিল যাযাবর বকরওয়াল জনজাতির মেয়ে। গ্রীষ্মে কাশ্মীরে থাকে এই পশুপালক জনজাতি, শীতে নেমে আসে জম্মুতে। ধর্ষণের খবর প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে আমরা জানি, মেহবুবা মুফতির সরকার বকরওয়ালদের জম্মুর জঙ্গল থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে নির্দেশ দিয়েছে বলেই স্থানীয় হিন্দুদের রাগ, আর সেই রাগ থেকেই শেষ অবধি এই নৃশংসতা। সেই জানার মধ্যে বিস্তর ফাঁক, আর প্রতিটা ফাঁকে রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা। যাযাবর জনজাতি যে থিতু হবে না জম্মুতে, এটা তো জম্মুর বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতাতেই জানার কথা। ২০০২ সালে গুজরাতের মুসলমানদের হাতে যেমন টাকা ছিল, আর্থিক সমৃদ্ধি ছিল, বকরওয়ালদের তা-ও নেই। ফলে, সাম্প্রদায়িক উস্কানির পিছনে বহু ক্ষেত্রেই যে আর্থিক যুক্তি থাকে, এই ক্ষেত্রে ছিল না তা-ও। তা হলে হঠাৎ এমন বিপুল বিদ্বেষ কেন?
কারণ, ফেব্রুয়ারি থেকে বিজেপির একটি অংশ জম্মুতে লাগাতার প্রচার করেছে, ধর্মে মুসলমান বকরওয়ালরা জম্মুতেই থেকে যাবে, পাল্টে যাবে জম্মুর জনসংখ্যায় হিন্দু-মুসলমানের অনুপাত। কাশ্মীরের মতো জম্মুতেও সংখ্যালঘু হয়ে যাবে হিন্দুরা। সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয় তৈরি করা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পুরনো খেলা। অসমে সে খেলায় লাভ হয়েছে বিস্তর। এ রাজ্যেও হচ্ছে। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজে সে ভয় ছড়ানোর খেলা চলছে। জম্মু-কাশ্মীরে এই ভয় ছড়িয়ে আগুন লাগানো অতি সহজ। ভারতের আর কোনও রাজ্যে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হিন্দুদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ হওয়ার গণস্মৃতি নেই আর কোথাও। জম্মুতে এই প্রচার বিলক্ষণ সফল হয়েছে।
সেই রাজনীতির পিছনেও আছে অন্য রাজনীতির খেলা। মেহবুবা মুফতির যে ‘নির্দেশ’ নিয়ে এই বিপুল প্রচার, বাস্তবে সম্ভবত তার অস্তিত্বই নেই। বকরওয়ালদের উচ্ছেদ করা যাবে না, মেহবুবা পুলিশকে এমন নির্দেশ দিয়েছেন বলে ফেব্রুয়ারিতে গুজব রটানো হয়। সম্ভবত নিখাদ গুজবই ছিল সেটা, কারণ পিডিপি-র মন্ত্রীরা তো বটেই, এমনকী বিজেপির মন্ত্রীরাও জানিয়েছেন, এমন কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তৈরি হয়নি কোনও সরকারি নির্দেশিকাও।
গুজবটাকে ছেড়ে দেওয়া যেত। বিজেপি ছাড়েনি। দলের জাতীয় সম্পাদক, কাশ্মীরের ভারপ্রাপ্ত নেতা রাম মাধব বুঝিয়ে দিয়েছেন, ছাড়বেনও না। মৃত মেয়েটির খুনিদের সমর্থনে বিজেপির যে দুই মন্ত্রী মিছিল করেছিলেন, তাঁরা পদত্যাগ করার পর রাম মাধব বলেছেন, এ বার মুখ্যমন্ত্রীকেও তাঁর ‘নির্দেশ’ প্রত্যাহার করতে হবে। কেন বিজেপি এই নির্দেশের গুজবটাকে মরতে দিতে রাজি নয়, বুঝতে সমস্যা নেই— হিন্দুদের মনে যত বেশি নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করা যাবে, রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি যত জোরদার হবে, বিজেপির ততই লাভ।
আট বছরের মেয়েটির ধর্ষণকে দেখতে হবে রাজনীতির তৈরি করে দেওয়া এই বিদ্বেষের জমিতে। সেই রাজনীতি, যার থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে আলাদা করা এখন অসম্ভব। নরেন্দ্র মোদী স্বভাবতই তা দেখতে দিতে চাইবেন না। তাঁকে বোঝা সহজ। কিন্তু, নাগরিক সমাজের একাংশ যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আপত্তি করে বলে, ‘মুসলমান’ মেয়েকে ধর্ষণ না বলে শুধু একটি বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ বলা হবে না কেন, প্রতিবাদ করার জন্য ‘মুসলমান’ পরিচিতিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে কেন— তখন সেই অবস্থানের পিছনে লুকিয়ে থাকা অরাজনীতির রাজনীতিকে ধরতে খানিক সময় লাগে।
ধর্ষণ পুরুষতন্ত্রের অস্ত্র, সন্দেহ নেই। ধর্ষিতা বালিকাটির ‘মেয়ে’ পরিচিতি গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই তাতেও। কিন্তু, তাকে শুধু ‘মেয়ে’ হিসেবে দেখলে, তার ‘মুসলমান’ পরিচিতিটাকে আলাদা ভাবে তুলে না ধরলে এই ধর্ষণের পিছনের রাজনীতির কথাগুলো আর বলার উপায় থাকবে না। বলা হয়ে উঠবে না, কী ভাবে গুজবকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি গুছিয়ে নিতে চায় ভোটব্যাঙ্ক। বলা হবে না, ‘মুসলমান’ না হলে হয়তো এ ভাবে মরতে হত না মেয়েটিকে। বলা হবে না, মুসলমানদের এ ভাবে মরতে হতেই পারে, এমন একটি আশঙ্কা তৈরি করে দেওয়াও এই ধর্ষণের হয়তো একটি উদ্দেশ্য ছিল। এবং, বলা হয়ে উঠবে না, এই মেয়েটি, বকরওয়াল জনজাতি, তাদের অরণ্যের অধিকার— সবই নিতান্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, আসল কথাটা হল মুসলমান ধর্মীয় পরিচিতি। অথবা, সেই পরিচিতিকে ব্যবহার করতে চায় যে রাজনীতি।
এই কথাগুলো বলা না হয়ে উঠলে কাঠুয়ার সঙ্গে নির্ভয়া-কাণ্ডের ফারাক করাও অসম্ভব হবে। দুটোই হয়ে দাঁড়াবে শুধুমাত্র মর্মান্তিক নৃশংসতার ঘটনা। এবং, যখন নরেন্দ্র মোদী বলবেন যে কাঠুয়ার ধর্ষণ নিয়ে রাজনীতি করা অনুচিত, তখন তাঁর সমালোচনায় এটুকুই বলা যাবে যে তিনি বিরোধী অবতারে এক রকম কথা বলতেন, আর শাসক অবতারে অন্য রকম। সেই সমালোচনা জরুরি, কিন্তু অগভীর। মেয়েটির পূর্ণ পরিচিতিকে সামনে রাখলে, বিজেপির বিভেদকামী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রেক্ষিতে তার মুসলমান পরিচিতির জন্যই তাকে ধর্ষিত হয়ে মরতে হল, এই কথাটা বার বার বললে বলা যাবে তার পরের কথাগুলোও। বলা যাবে, কেন নরেন্দ্র মোদীরা এই ধর্ষণকে রাজনীতির আওতার বাইরে রাখতে উদ্গ্রীব। বলা যাবে, মেয়েটির মৃত্যুর জন্য আসলে দায়ী তাঁরাই। বিভাজনের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে, মুসলমানদের ক্রমাগত কোণঠাসা হতে দিয়েছেন বলে। এই জমানাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা বৈধতা অর্জন করেছে বলে। এক বারের জন্যও উগ্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে উঠতে পারেননি বলে। এই মর্মান্তিক মৃত্যুর নৈতিক দায় না নিয়ে তাঁদের উপায় নেই, এই কথাটা স্পষ্ট করে বলার জন্যই বার বার ধর্ষিতা মেয়েটির পুরো পরিচিতির কথা উল্লেখ করে চলতে হবে।
এ অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে কঠিন। তাই তিনি বকরওয়াল জনজাতির মেয়েটির মৃত্যুকে রাজনীতির বাইরে রাখতে চাইবেনই। কিন্তু, কোনও হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা ছাড়াই যাঁরা বলছেন ধর্ষণের ধর্ম হয় না, মেয়েটিকে শুধু একটি মেয়ে হিসেবেই দেখতে হবে, এই আখ্যান থেকে রাজনীতির প্রশ্নটা সরে গেলে কার ক্ষতি, কার লাভ, সেই হিসেবটা তাঁরা কষে দেখতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy