Advertisement
E-Paper

নামভূমিকায়: সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর

রাজনীতিতে বিরাট সাফল্য, কেননা কূটনীতিতে পশ্চিমি আধিপত্যবাদকে সরিয়ে অন্য ভাষ্য তৈরি করতে সদা ব্যস্ত রয়েছেন বিদেশমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:১৯
Share
Save

ভারতের মতো দেশের বিদেশমন্ত্রিত্বের বিপুল চাপকে সহজ করে নিতে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার এক মঞ্চে একাধিক টোটকা দিয়েছেন সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর, কিছুটা চপল চালে। পাশাপাশি চাপ কাটিয়ে উন্নতির জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন তিনটি ‘সি’-তে। একটি ‘সি’ হল কন্ট্যাক্ট অর্থাৎ যোগাযোগ। যত বেশি লোককে তুমি জানবে, তত বেশি নিজেকে ছড়াতে পারবে। দ্বিতীয় ‘সি’-টি কেমিস্ট্রি অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। যত ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে, তত বেশি মানুষ তোমার জন্য কাজ করবে। তিন নম্বর ‘সি’-টি মোক্ষম অর্থাৎ ক্রেডিবিলিটি। অর্থাৎ, এ এমন একটি গুণ যা অর্জন করতে পারলে মানুষ তোমার কথাকে গুরুত্ব দেবে।

প্রথম দু’টি যে কোনও কূটনীতিকেরই মৌলিক কাজ, উনিশ বিশ সবাই তার চর্চা করে থাকেন। কিন্তু জওহরলাল নেহরুর পর দেশের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটি কী, তা কৌশলে নিজেই ওই অস্ট্রেলিয়ার মঞ্চে জানিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বমঞ্চে নরেন্দ্র মোদীর গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য একটি আগ্রাসী, জাতীয়তাবাদে ভরপুর ভাষ্য তৈরি করা। ২০১৯-এর মে মাসে বিদেশ সচিবের পদ ছেড়ে যখন তিনি মন্ত্রিসভায় ঢুকলেন, অনেকে ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল। রাজনৈতিক গুরুত্বের হিসাবে তিনি ছিলেন লঘুভার, আরএসএস-র প্রসাদী চন্দন তাঁর ললাটে ছিল না, অন্য অনেক ভাষায় পারদর্শী হলেও হিন্দি ভাষায় তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত ছিল না কখনওই।

তা হলে কী ছিল তাঁর তূণীরে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিঃশর্ত আস্থা। এই আস্থা জয়শঙ্করের স্বোপার্জিত। মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে চিন সফরে গিয়ে, সে দেশে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এস জয়শঙ্করের সক্রিয়তা দেখেছিলেন। বাড়তি পরিশ্রম করে মোদীর রাজ্যের জন্য চিনের বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর মেলা লাগিয়ে দিয়েছিলেন জয়শঙ্কর (মনে রাখতে হবে সেটা ছিল ইউপিএ জমানা) তাতে যুগপৎ মুগ্ধ ও খুশি হয়েছিলেন মোদী। যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন দু’জনেই।

তবে শুধুমাত্র এই একটি অতীত আস্থার উপর ভরসা করেই বিদেশমন্ত্রিত্বের কণ্টকাকীর্ণ ছ’বছরের পথ একটানা পাড়ি দিচ্ছেন না জয়শঙ্কর। তৃতীয় ‘সি’-টিকে তিনি এক অভূতপূর্ব জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করলেন যা তাঁর আগে কোনও বিদেশমন্ত্রীকে বিশেষ করতে দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক মঞ্চে নরেন্দ্র মোদীর ‘বিশ্বগুরু’ অথবা ‘বিশ্বমিত্র’ ভাবমূর্তি তৈরির পিছনে ভাষ্যশিল্পী হিসাবে নিরলস থাকলেন তিনি। পুরস্কারস্বরূপ এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় তাঁর দৃশ্যমানতা, গতিময়তা এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব, পোড়খাওয়া রাজনীতিক রাজনাথ সিংহ অথবা নিতিন গডকড়ীর তুলনায় অনেক বেশি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে গবেষণা করা জয়শঙ্কর দেশের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক অতীত গৌরব, অতিকথা বা মিথ, সত্য-উত্তর রাজনীতি (পোস্ট-ট্রুথ)-র সঙ্গে আবেগী ও ঝাঁঝালো জাতীয়তাবাদ মিশিয়ে এক অপূর্ব ভাষ্য তৈরি করলেন। মোদীর দূত হিসাবে ইউরোপ থেকে আমেরিকা, গ্লোবাল সাউথ থেকে প্রতিবেশী বলয়— সর্বত্র দাপটের সঙ্গে তা প্রচার করতে থাকলেন। ভিতরে ভিতরে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের কূটনীতি বহাল রেখে ভারতের দর্পিত শক্তির একটি ছবি তিনি চমৎকার ভাবে আঁকলেন বিশ্ব জুড়ে। যাকে পরিভাষায় বলা হয় ‘লিপ সার্ভিস’, যা নাকি কূটনীতির অঙ্গ, তাকে সর্বোত্তম জায়গায় নিয়ে গেলেন বিশ্বজোড়া ভূকৌশলগত সঙ্কট এবং যুদ্ধের মধ্যে।

যে ভাষ্যটি তৈরি করলেন জয়শঙ্কর, তার মূলমন্ত্র হল পশ্চিমের আধিপত্যবাদকে অস্বীকার করা। কিন্তু অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উচ্চপ্রযুক্তি, মহাকাশ, রসায়ন, পরিবেশ, কৃত্রিম মেধার মতো বিষয় থেকে পশ্চিমি সহায়তা ও অংশীদারি কমানোর মতো মূর্খামি তিনি করলেন না। সে সব বহাল রেখেই, বা বাড়ানোর চেষ্টার পাশাপাশি একটি বাগ্‌ভঙ্গি ও বাগ্‌দর্শন তৈরি করতে চেষ্টা করলেন, যেখানে ভারত তর্কাতীত ভাবে জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্ঠিত। গত বছর পুণের একটি অনুষ্ঠানে জয়শঙ্কর নিজেই ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে পশ্চিমের ‘প্রিজ়ম’ থেকে হটিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা করার জন্য ভারতের প্রয়োজন নিজস্ব এক ভাষ্য। তাঁর বক্তব্য, অর্থনীতি রাজনীতির ভরকেন্দ্র পশ্চিম থেকে সরে গিয়ে এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু সেই আগের সংস্কৃতি যদি না বদলায়, তা হলে গোটা প্রক্রিয়াটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

বলা বাহুল্য, এই দর্শন সঙ্ঘের রাজনীতির সঙ্গে এবং মোদীর শ্লাঘাপূর্ণ ভাবমূর্তির প্রক্ষেপণের প্রশ্নে চমৎকার। তাই জি২০-র মঞ্চই হোক বা ইউরোপ-নীতি, জয়শঙ্কর রাজনৈতিক ওজনের ভরকেন্দ্র বদলের ডাক দিয়ে গেলেন। বললেন, এত দিন ধরে ভারত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি ‘ওদের’ সুরে সুর মিলিয়ে গিয়েছে। নিজেদের আদর্শে আলো ফেলার জন্য পশ্চিমের প্রদীপেরও প্রয়োজন নেই। রাশিয়া থেকে ভারতের অশোধিত তেল কেনা নিয়ে পশ্চিমের রক্তচক্ষুর সামনে বললেন, “আমরা গোটা মাসে যে তেল রাশিয়া থেকে আমদানি করি, ইউরোপ এক বিকেলেই সেটা কেনে!”

কূটনীতির এমন ‘অন্য ভাষ্য’ তৈরির পরিশ্রম এই সত্তর বছর বয়সেও অক্লান্ত ভাবে করে চলেছেন জয়শঙ্কর। বিশ্বের এক প্রান্তে প্রাতরাশ, অন্য প্রান্তে নৈশভোজ— এই নিয়মিত দিনযাপনের মধ্যে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

S. Jaishankar indian politician Subrahmanyam Jaishankar

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}