এ বারের লোকসভা নির্বাচনের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ কে? বাছতে হলে নিশ্চিত ভাবে অখিলেশ যাদব ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এক জন উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে ধাক্কা দিয়েছেন। অন্য জন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে বাড়তে তো দেনইনি, উল্টে ডানা ছেঁটেছেন। শেষ পর্যন্ত কি অখিলেশকেই ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’-এর ট্রফিটা দিতে হবে? কারণ তাঁর লড়াইয়ের ময়দান উত্তরপ্রদেশ। নরেন্দ্র মোদী, যোগী আদিত্যনাথ ও হিন্দুত্বের শক্ত ঘাঁটি।
মুলায়ম সিংহ যাদব ছেলের জন্মের সময়ও এত ব্যস্ত ছিলেন যে, সাইফাইয়ের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ারই সময় পাননি। গ্রামের সরপঞ্চ নাম রাখেন টিপু। স্কুলে ভর্তির সময় তাড়াহুড়ো করে অখিলেশ নাম ঠিক হয়। সেই টিপুই এ বার উত্তরপ্রদেশে নরেন্দ্র মোদীর অশ্বমেধের ঘোড়া থামিয়ে দিয়েছেন। ‘চারশো পার’ দূরে থাক, বিজেপি যে এ বার লোকসভায় ২৭২-এর ম্যাজিক সংখ্যাও পার করেনি, তার অন্যতম কারণ অখিলেশ। উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৬২টি আসনে লড়ে সমাজবাদী পার্টি এ বার ৩৭টিতে জিতেছে। অখিলেশের কাঁধে ভর করে কংগ্রেসও কোমর ভাঙা সংগঠন নিয়ে ১৭টি আসনে লড়ে আধ ডজন আসন জিতে গিয়েছে। বিজেপি মাত্র ৩৩টি আসনে আটকে থেকেছে।
অখিলেশ যাদবের এর চেয়েও বড় সাফল্য হল, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে আবার মণ্ডল বনাম কমণ্ডলু রাজনীতির প্রত্যাবর্তন। সমাজবাদী পার্টি গোড়া থেকেই রামমনোহর লোহিয়ার জাতপাতভিত্তিক সামাজিক ন্যায়ের মতাদর্শে বিশ্বাসী। মুলায়ম সিংহ যাদব ১৯৯২-এ সমাজবাদী পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তত দিনে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করে ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। সেই মণ্ডল রাজনীতির সুবিধা মুলায়ম পেয়েছিলেন। ওবিসি-দের, বিশেষত প্রভাবশালী, বড়লোক, জমির মালিক যাদবদের মসিহা হয়ে উঠেছিলেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে কংগ্রেসের প্রতি মোহভঙ্গ হওয়া মুসলিমরাও তাঁর ছাতার তলায় ভিড়েছিলেন।
মণ্ডল বনাম কমণ্ডলুর রাজনীতিতে বিজেপি বরাবরই রামমন্দির এবং মেরুকরণের রাজনীতিকে সামনে রেখে জাতপাত নির্বিশেষে গোটা হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে এক ছাতার তলায় আনতে চেয়েছে। নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহ সে কাজে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। যাদব বাদে অন্যান্য ওবিসি এবং মায়াবতীর নিজস্ব জাটভ সম্প্রদায় বাদে বাকি দলিতদের ভোট বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছিল। তার উপরে অখিলেশ সরকারের আমলে সমাজবাদী পার্টিতে উত্তরপ্রদেশের ‘ডন’, গুন্ডা-মাফিয়ারা আশ্রয় নেওয়ায় আমজনতা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
অখিলেশ যখন মুখ্যমন্ত্রী, তখন লখনউয়ের কালিদাস মার্গে সরকারি বাসভবনে একটা ‘ইনস্টলেশন’ ছিল। দলের প্রতীক সাইকেলের টুকরো টুকরো অংশ। যার উপর আলো পড়লে দেওয়ালে মুলায়ম সিংহ যাদবের মুখের ছায়া-ছবি তৈরি হত। অখিলেশ মুলায়মের ছায়া থেকে বেরিয়ে গুন্ডা-মাফিয়া-ডনদের থেকে দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছিলেন। বাপ-কাকার সঙ্গে সংঘাতের তখন থেকেই শুরু। অখিলেশ বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু মুসলিম-যাদব ভোট দিয়ে বিজেপির মোকাবিলা করা কঠিন। উচ্চবর্ণ, দলিত ভোটও টানতে হবে। তাই এ বার তাঁর মন্ত্র ছিল—‘পিছড়া, দলিত ও অল্পসংখ্যক’ বা ‘পিডিএ’।
মুলায়মের জমানায় সমাজবাদী পার্টির শতকরা চল্লিশ ভাগ টিকিট পেতেন যাদব-মুসলিমরা। এ বার উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ৮০টি-র মধ্যে ৬২টি আসনে লড়েছে। যাদবদের মাত্র ৫ জন, মুসলিমদের মাত্র ৪ জন টিকিট পেয়েছেন। যাদব ছাড়া অন্যান্য ওবিসি-দের মধ্যে থেকে ২৭ জনকে প্রার্থী করেছিলেন অখিলেশ। যাদব-নেতার ছেলে হলেও অখিলেশ রাজপুত পরিবারের মেয়ে ডিম্পলকে বিয়ে করেছিলেন। বাবার ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয়কে তোয়াক্কা করেননি। এ বার তিনি ব্রাহ্মণ-রাজপুত মিলিয়ে উচ্চবর্ণের ১০ জনকে টিকিট দিয়েছিলেন। আর ১৬ জন দলিতকে প্রার্থী করেছিলেন। অযোধ্যার রামমন্দির যে ফৈজ়াবাদ লোকসভা কেন্দ্রের আওতায়, সেখানে সমাজবাদী পার্টির দলিত নেতা অবধেশ প্রসাদ সাংসদ হয়েছেন।
এ যেন মুলায়ম-উত্তর জমানায় সমাজবাদী পার্টির দ্বিতীয় অবতার। কিন্তু পঞ্চাশে পা দেওয়া অখিলেশ যাদবের পুনরুত্থান হল কি? তিনি জাতপাতের নতুন সমীকরণ করেছেন ঠিকই, তবে কেন্দ্রের মোদী-সরকার, রাজ্যের যোগী-সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষও তিনি পেয়েছেন। তা সে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, অগ্নিবীর নিয়ে ক্ষোভ হোক বা যোগীর ‘বুলডোজ়ার’ সরকারের আমলে উত্তরপ্রদেশের অর্থনীতির করুণ দশা বা উগ্র হিন্দুত্বের ঠেলায় বেওয়ারিশ গরু-মোষ নিয়ে চাষিদের অসন্তোষ— ভোটের বাক্সে সমাজবাদী পার্টি ও তার শরিক কংগ্রেসকেই সুবিধা দিয়েছে।
লখনউয়ের রাজনীতি জানে, অখিলেশের মুখের হাসি দেখে তাঁর মনের কথা বোঝা যায় না। যে রাহুল গান্ধীকে তিনি এক সময় ঘরোয়া আড্ডায় হাসিঠাট্টা করতেন, এখন তাঁর সঙ্গেই হাত মিলিয়েছেন। যেমন অতীতে মায়াবতীর সঙ্গে জোট করেছিলেন। তেমনই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও তিনি ব্যক্তিগত শত্রুতায় বিশ্বাস করেন না। বিধানসভায় তাঁর কটাক্ষ শুনে যোগীও চটে না গিয়ে মিটিমিটি হাসেন।
লোকসভা ভোটে অখিলেশের ঝুলিতে ভোট উপচে পড়লেও তার কতখানি সমাজবাদী পার্টির পক্ষে ভোট আর কতখানি বিজেপির প্রতি অসন্তোষের ভোট, এর উত্তর এখনও মেলেনি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে উত্তরপ্রদেশের খান দশেক বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বা ২০২৭-এর বিধানসভা ভোটে এর উত্তর মিলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy