শুনেছিলাম অসুস্থ। যত দিন ধরে ওঁকে জানি, তাও আজ চল্লিশ বছরের উপরে হয়ে গেল, কোনও দিনই সম্পূর্ণ সুস্থ দেখিনি নবনীতাদিকে। হাঁপানির কষ্ট দেখেছি। বছর বারো আগে শিকাগো এসেছিলেন বক্তৃতা করতে। তখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হত। মেশিনে চড়ে উঠতেন। কিন্তু মুখের হাসিটি অমলিন। আমি ঠাট্টা করে বললাম, ‘‘আর একটু খবর দিয়ে আসবেন তো? প্রচারে নামতে হবে না?’’ হাসলেন, সেই বুঝদার হাসি। আজকের পৃথিবীটা কী ভাবে চলে, লেখাপড়ার জগতেও যে প্রচারের প্রচলন হয়েছে, এ সব তাঁর অজানা ছিল না। ওঁর হাস্যরসমূলক অনেক লেখাতেই দেখেছি, চেনা পৃথিবীটাকে যেন একটু দূর থেকে দেখতেন আর মানুষের পৃথিবীর নানান অসঙ্গতি দেখে নিজের মনেই যেন হাসতেন। বুদ্ধি, বিদ্যা ও সূক্ষ্ম অনুভূতি মিশিয়ে বাংলা লিখতেন নবনীতাদি। এটা সবাই পারে না। হাসির মাধ্যমে ওঁর বুদ্ধিবৃত্তির এমন একটি প্রকাশ হত যা সত্য হলেও মানুষকে আহত করত না। ওঁর সঙ্গে আমরাও হাসতাম নিজেদেরই অসঙ্গতিতে। শেষ দেখা হয়েছিল তপন রায়চৌধুরীর এক স্মৃতিসভায়। হাস্যরসপ্রিয় তপনদা ছিলেন নবনীতাদিরও এক প্রিয় মানুষ। সেই সভায় যেন তপনদার স্মৃতিকে উপলক্ষ করে আমরা হাসির জয়গানই গেয়েছিলাম। আর নবনীতাদির হাসির পরিচয় যাঁরাই পেয়েছেন তাঁরা সকলেই জানেন কী প্রাণোচ্ছল ছিল সেই হাসি।
হালফিল শুনতাম দুরারোগ্য অসুখ নবনীতাদির। অথচ হাসিটি যে শুকোয়নি, জানতাম। এই তো সে দিন বন্ধুরা পাঠালেন ওঁর ছোট্ট একটি রম্যরচনা। বিষয়: মৃত্যু। অবধারিত জেনেও তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করা। বোঝা যায়, যা আসছে তাকে নিয়ে তাঁর মনে কোনও অস্থিরতা নেই। এইটেই নবনীতাদি। অসীম সাহসী। এক সময় বিবাহবিচ্ছেদের পর একা হয়ে গিয়ে দেশে ফিরে সম্পূর্ণ এক নতুন জীবন নিজের গুণে তৈরি করেছিলেন। নিজের দুঃখের কথা লুকিয়ে মিথ্যে বাহাদুরির প্রশংসা চাননি, আবার নিজের স্বাধীনতাও এতটুকু ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। নিজের মহিমায় অবলীলায় জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের জগতে। লেখাপড়ার জগতেও তাঁর বিচরণ ছিল নির্ভার। যতই তাঁর স্বাস্থ্যের বিড়ম্বনা থাক, মানুষটার প্রাণশক্তিতে বিশ্বাস করেছি। তাই আজ, আমেরিকার ৭ নভেম্বরের সকালবেলা, যখন কলকাতার বন্ধু জানালেন ‘নবনীতাদি চলে গেলেন’, তখন অকস্মাৎ বেদনায় বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম।
নবনীতাদিকে আমার চেয়ে ভাল চিনতেন, তাঁর রচনা ও জীবন নিয়ে কোনও সম্যক ধারণার ভিত্তিতে কিছু লিখতে পারবেন, এমন মানুষ অনেক আছেন। আমি তাঁদের সমকক্ষ নই। অল্পই দেখেছি নবনীতাদিকে। যত বার দেখেছি ততই মনে হয়েছে যেন না-দেখায় যোগাযোগের কিছু মাত্র ক্ষতি হয়নি। ওঁর স্নেহের উপরে আমার দাবি এতটুকু কমেনি। তা ছাড়াও অযাচিত ভাবে নবনীতাদি আমার অনেক উপকার করেছেন। ওঁর এই পরোপকারী দিকটারও একটা স্বীকৃতি থাকা দরকার। নবনীতাদিকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে তাই অল্প কিছু লিখতে ইচ্ছে করল। কিছুটা স্মৃতিতর্পণের মতোই।
উপকারের কথাটা দিয়েই শুরু করি। ১৯৭৭-৭৮ সালের কথা। তখন আমি অস্ট্রেলিয়ায় বসে বাংলার চটকল শ্রমিকের ইতিহাস নিয়ে পিএইচ ডি ডিগ্রির জন্য গবেষণারত। কলকাতায় এসেছি গবেষণা সূত্রে। কী ভাবে নবনীতাদির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হল, তা এখন আর মনে নেই। কিন্তু মনে আছে কী একটা কথায় কথায় আমি কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরীর কথা তুললাম। ভদ্রলোক শ্রমিক সংগঠন করতেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ও তার ঠিক পর পর। বামপন্থীদের চোখে সরকারের ‘পোঁ ধরা’ মানুষ ছিলেন, সরকারের মনোনীত শ্রমিক প্রতিনিধি ছিলেন, তাই বাম রচিত ইতিহাসে ওঁর যে ছবি পাওয়া যায় তা ওঁর পক্ষে গৌরবের নয়। কিন্তু আমার তখন ইতিহাসবিদ হিসেবে এই মানুষটির কাজেকর্মেও আগ্রহ। আর অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে কলকাতা শহরে কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা ঐতিহাসিক কাগজপত্র পাওয়া কত কঠিন। কত জায়গায় নিষ্ফল মাথা খুঁড়েছি। যখন উনিশ শতকের শ্রমিক-সংগঠক শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গবেষণা করেছিলাম, ব্রাহ্ম সমাজের এক মাথা আমাকে অনেক ঘুরিয়ে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই প্রয়োজনের কথা পাড়ি সবার সঙ্গেই। যদি কেউ পারেন সাহায্য করতে। নবনীতাদিকে কৃষ্ণচন্দ্রের কথা বলতে একটু ভেবে বললেন, ‘‘আমার সঙ্গে এখনই চলো।’’ যত দূর মনে পড়ে, বললেন এক আত্মীয়ের কথা। বলে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের এক পরিচিত বাড়িতে নিয়ে গেলেন। জাস্টিস পি বি চক্রবর্তীর বাড়ি। সেখানে পরিচয় হল তাঁর বৃদ্ধ ভাই বসুধা চক্রবর্তীর সঙ্গে। বসুধাবাবু পুরনো দিনের ‘রয়িস্ট’। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম কৃষ্ণচন্দ্রের সমস্ত কাগজপত্র তাঁর ব্যক্তিগত হেফাজতে আছে। উনি এ পর্যন্ত তা কাউকে দেননি। আগলে বসে আছেন। নবনীতাদির সুপারিশেই বোধ হয়, আমার হাতে সমস্ত কাগজ দিয়ে বললেন, ‘‘আমি এ সব নিয়ে বসে আছি উপযুক্ত কোনও মানুষকে দেব বলে যাতে এগুলো থেকে যায়। আমার বয়স হয়ে গিয়েছে, তুমি এগুলো নিয়ে যাও।’’ নবনীতাদির কল্যাণেই এই একটা আশ্চর্য মুহূর্ত এল আমার জীবনে। সাহিত্যের মতো ইতিহাসও জীবনে জীবন যোগ করে। সে দিন কেমন কৃষ্ণচন্দ্রের জীবন, বসুধা চক্রবর্তীর জীবন ও নগণ্য আমার জীবন এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল— সুতো বাঁধলেন নবনীতাদিই।
একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। নবনীতাদির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সময়ে আমি আমার বাঙাল পূর্বপুরুষদের দেশভাগের দুঃখ নিয়ে বাঙাল ইংরেজিতে কিন্তু বাংলা পল্লিগীতির সুরে একটি হাসির গান বেঁধেছিলাম: ‘‘ইন আওয়ার নেটিব ভিলেজ’’ ইত্যাদি। গানটি নবনীতাদির খুব পছন্দ ছিল। কোনও সভায় দেখা হলে আমাকে দিয়ে প্রায়ই গাওয়াতেন। এবং মাঝে মাঝেই ওঁর বাড়িতে গানের সভা বসিয়ে রাত্তিরে খেয়ে যেতে বলতেন। তখন ওঁর মেয়েরা ছোট। তারাও এই সব গান শুনে মজা পেত। কিন্তু খেতে খেতে অনেক সময় এত রাত হত যে নবনীতাদি বলতেন, রাত্তিরে থেকে যাও। নবনীতাদির বাড়িতে সব সময়ই দেখতাম নানা মানুষ নানা সম্বন্ধ পাতিয়ে থাকতেন, আমিও তাঁদেরই এক জন হয়ে থেকে যেতাম। মুশকিল হত সকালবেলা। কী খাওয়া হবে সকালবেলা? নবনীতাদির বাড়িতে তখন হুলস্থুল— রুটি আন, দুধ আন, মাখন আন, জ্যাম আন! বাড়িতে যেন কিচ্ছু নেই। থাকা হয়তো সম্ভবও ছিল না। সকালে ক’জনের পাত পড়বে, তার তো কোনও ঠিক নেই। আমি কিন্তু নবনীতাদিকে দেখে অবাক হয়ে যেতাম— সংসার যাঁর আপাত ভাবে এত অগোছালো, তাঁর চিন্তা কী অসম্ভব গোছানো! ওই অত হট্টগোলের মধ্যে যখন লিখতে বসতেন, তখন যেন তিনি ধ্যানস্থ। নানা ধরনের রচনায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিহার। অজস্র বাঙালির তিনি প্রিয় লেখিকা। অজস্র মানুষের আশ্রয়।
ক’দিন আগেও নিজের মৃত্যু নিয়ে ঠাট্টা করে গিয়েছেন নবনীতাদি। ‘অল্রাইট কামেন্ ফাইট্! কামেন্ ফাইট্!’ নামক সে রচনা আমাদের ফোনে ফোনে ঘুরেছে। লিখেছিলেন, ‘‘আমার কি তালা-ভাঙা দরজার অভাব আছে? আমার তো হৃৎকমল থেকে শ্বাসকমল— সব দরজাই আধখোলা।’’ নবনীতাদি কি জানতেন বাঙালি পাঠকের হৃৎকমল থেকে শ্বাসকমল— সর্বত্রই তাঁর অবাধ আনাগোনা? তাঁর জন্য আমাদের মনের সব দরজাই— আধ নয়, হাট করে খোলা থাকবে বহু বহু কাল, অন্তত যত দিন বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকবে।
ইতিহাস বিভাগ, শিকাগো ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy